দুর্ঘটনা সব জায়গায় ঘটলেও, সব দুর্ঘটনা সমান নয়। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হবার ১৮ ঘণ্টারও বেশি সময় পর প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ৯ আরোহীর মৃত্যুর খবর জানায় তেহরান। এরইমধ্যে শুরু হয়েছে রাইসি ও তাঁর সঙ্গে নিহতদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান।
ইরান এমন কোনো দেশ নয়, যেখানে প্রেসিডেন্টের মতো শীর্ষ ব্যক্তিরা দুর্ঘটনাক্রমে মারা যান। তবে এটি এমন একটি দেশ, যেখানে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে দুঃখজনক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। আগের বছরগুলোতে, অন্তত দুজন মন্ত্রী এবং দু’জন শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা একই ধরনের দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
রাইসির হেলিকপ্টার, যা ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দুই শীর্ষস্থানীয় আঞ্চলিক কর্মকর্তাকেও বহন করে ছিলো, সেটি উত্তর-পশ্চিম ইরানের একটি ভয়াবহ কুয়াশাচ্ছন্ন এবং পাহাড়ি এলাকার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো। এতে করে হেলিকপ্টারটি এক বিশ্বাসযোগ্য দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে, আপাতত এটিই গ্রহণযোগ্য।
তবুও দুর্ঘটনাটিকে ঘিরে অনিবার্যভাবে সন্দেহ থেকে যাবে। ১৯৬১ সালে উত্তর রোডেশিয়ায়, ১৯৭১ সালে চীনে, ১৯৮৮ সালে পাকিস্তান এবং পোল্যান্ডে ২০১০ সালের উড়ান দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলো শীর্ষ সব রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের নিহত হবার ঘটনাগুলো এখনও জল্পনা-কল্পনার বিষয়।
তাই রাইসির দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও জল্পনা তৈরি হতেই থাকবে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি সবার মধ্যে তাড়া করছে, সেটি হলো- রাইসির মৃত্যু থেকে রাজনৈতিকভাবে কারা লাভবান হবে? শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টার বিধ্বসের কারণ জানা না গেলেও, ইরানের পরবর্তী ঘটনাগুলোর দিকে সবার নজর থাকবে।
সর্বোচ্চ নেতা, যাকে শিয়া ইসলামী ধর্মতত্ত্বে ভেলায়ত-ই ফকিহ নামেও পরিচিত, তিনি ইরানের চূড়ান্ত শাসক এবং রাষ্ট্র সংক্রান্ত সমস্ত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দায়ী। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পরে প্রতিষ্ঠিত একটি অবস্থান, এছাড়াও রাষ্ট্রের প্রধান এবং কমান্ডার ইন চিফ।
একজন আয়াতুল্লাহ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হবে। আয়াতুল্লাহ হচ্ছে শিয়া ধর্মতত্ত্বে সর্বোচ্চ শিক্ষা নেয়া ব্যক্তি। যদিও খামেনি নিজে কখনো সেই স্তরে পৌঁছেছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাহী শাখার প্রধান এবং প্রতি চার বছরে একটি সুক্ষ্মভাবে যাচাই করা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সেই ব্যক্তির রাজনৈতিক পটভূমি ও শক্তির উপর নির্ভর করে, রাষ্ট্রীয় নীতি এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। ইব্রাহিম রাইসি ঠিক তেমনই এক শক্তিশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন এবং তিনি খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে উঠেন।
রাইসি ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হবেন, এমনটাই প্রবলভাবে মনে করা হচ্ছিলো। তবে একটি নাটকীয় দুর্ঘটনা সেই হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়েছে। বর্তমানের সর্বোচ্চ নেতা ৮৫ বছরের খামেনির শারীরিক অবস্থা অনেকদিন ধরেই আগ্রহের কেন্দ্রে। ফলে তার আসনে কে বসবেন, সেই আলোচনা আবার গতি পেলো।
মধ্যপ্রাচ্য থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোর ধারণা, এখন এমন একজনের খোঁজ চালবে, যিনি খামেনির প্রতি সেরা আনুগত্য দেখাবেন; একই সঙ্গে ইরানের রক্ষণশীল ঐক্য বজায় রাখতে পারবেন। অন্যদিকে, তার বিরোধীরা এটাও আশা করবে যে, ইব্রাহিম রাইসির প্রস্থান রক্ষণশীল শাসন ব্যবস্থার অবসান ত্বরান্বিত করবে।
এই মুহূর্তে রাইসির সমমর্যাদার কোন ব্যক্তির নাম পাওয়া যাচ্ছে না, যাকে এককভাবে সর্বোচ্চ নেতার পদে ভাবা যাচ্ছে। তবে, দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ধর্মীয় অভিভাবকরা, কিছু সময়ের জন্য হলেও খামেনির ছেলে মোজতবা খামেনিকে শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।
তবে এমনটি হলে ইরানের শাসন ব্যবস্থার জন্য একটি বিপজ্জনক অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। কারণ ইরানে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েই কট্টরপন্থী ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিলো। এই বিষয়টিকে সামনে রেখে তৎপর হতে পারে ইরানের মধ্যপন্থীরা। তবে তাদের মধ্যেও আছে নানা মত।
আবার মধ্যপন্থীদের ঠেকাতে গিয়ে যাতে অতি কট্টরপন্থীদের উত্থান না ঘটে, সেই দিকেও সতর্ক নজর রয়েছে দেশটির প্রভাবশালী বিপ্লবী ইসলামিক গার্ড বাহিনীর। এক্ষেত্রে আবারও খামেনিপুত্র মোজতবাই সামনে চলে আসছেন। তাই রাইসির মৃত্যুর পর মোজতবাই সর্বোচ্চ নেতার উত্তরসূরি বলে এগিয়ে রাখছেন বিশ্লেষকরা।