কী এই এল ডোরাডো, কেনো এতো অভিযান?
নতুন সময় ডেস্ক
|
স্বর্ণের প্রতি আকর্ষণ দেশ, কাল ও যুগের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় তা মানুষের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে এমনভাবে জাগিয়ে তোলে, যা সহজে দুর করা যায় না। তাইতো স্বর্ণের খোঁজে মানুষের লোমহর্ষক ও প্রাণহানিকর সব অভিযানের সাক্ষী হয়ে আছে ইতিহাস। চকচকে এই ধাতুর প্রতি মানুষের ‘লালসা’র কারণে ইতিহাসের পাতায় ‘এল ডোরাডো’র মতো অনেক গল্পের জন্ম হয়েছে। ১৬ ও ১৭ শতকের দিকে ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করত যে, নতুন বিশ্বে এল ডোরাডো নামে এক সোনার শহর আছে; যেখানে রয়েছে সম্পদের প্রাচুর্য। আর এই সোনার শহর ও গুপ্তধনের প্রত্যাশায় বহু অভিযান চালানো হয়েছে, যেজন্য জীবন দিতে হয়েছে বহু মানুষের। অভিশপ্ত এই এল ডোরাডোর খোঁজে আত্মহত্যা ও শিরশ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে। তার পরেও এল ডোরাডো নিয়ে আজও মানুষের কৌতূহলের কমতি নেই। কিন্তু এই এল ডোরাডো কী? আসলেও কি এল ডোরাডো একটি শহর, না কোনো ব্যক্তি, নাকি শুধুই একটি হ্রদ; যার নিচে আছে অসংখ্য সোনা। ইতিহাসের পাতায় এখনও এই প্রশ্ন উঠে চলেছে। এল ডোরাডো ধারণা করা হয়, এল ডোরাডোর উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার পূর্বে, যা এখন কলম্বিয়ার মধ্যে। কিন্তু আজ পর্যন্তও সঠিক অবস্থান জানা যায়নি এই শহরের। ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি এনসাইক্লোপিডিয়া অনুসারে, মুইসকা উপজাতির আদিবাসীদের থেকে উৎপত্তি এল ডোরাডো গল্পের সূত্র। বছরে একবার ওই গোষ্ঠীর প্রধান সারা দেহে টারপেনটাইন ও সোনার ধুলা মেখে গুয়াতাভিটা হ্রদে যেতেন। অনুষ্ঠানের সময় মুইসকারা ওই হ্রদে ফেলে দিতেন সোনা ও মূল্যবান রত্ন। হ্রদের দেবতাকে খুশি করার জন্য এটি ছিলো মুইসকাদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ১৫ শতকের শেষের দিকে মুইসকারা অন্য একটি উপজাতির কাছে পরাজিত হয়েছিলো। আর এরই সাথে সাথে গুয়াতাভিটা হ্রদের অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৬ শতকের শুরুর দিকে স্প্যানিশ অনুসন্ধানকারীরা যখন দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছেছিলো, তখন তারা আন্দিজ পর্বতমালার সেই হ্রদের গল্প শোনেন। কিন্তু তারা কেউ এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি চোখে দেখেনি। তা সত্ত্বেও স্প্যানিয়ার্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করতে থাকে যে, দক্ষিণ আমেরিকায় এমন কোনো জায়গা আছে, যেখানে প্রচুর সোনা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। মহাদেশের উত্তর উপকূল ধরে স্থানীয়দের কাছে থেকে প্রচুর সোনা পাওয়ায় এই বিশ্বাস সৃষ্টি হয় তাদের। স্প্যানিয়ার্ডরা সেই জায়গাকে ‘এল ডোরাডো’ ডাকতে শুরু করে, যার অর্থ ‘সোনায় মোড়া’। অনেক অভিযানের পরেও এল ডোরাডো খুঁজে পাননি স্প্যানিয়ার্ডরা। তবে পেয়েছিলেন সেই গুয়াতাভিটা হ্রদ এবং ১৫৪৫ সালে পানি নিষ্কাশন করার চেষ্টা করে। আর এটা করতে গিয়েই স্প্যানিয়ার্ডরা ওই হ্রদের ধারে অসংখ্য সোনার টুকরো খুঁজে পায়। কিন্তু হ্রদ খুব গভীর হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ পানি নিষ্কাশন করতে পারেনি তারা। এল ডোরাডোর জন্য পিজারোর অনুসন্ধান ১৫৪১ সালে স্পেনের জয়ের শাসক বিজয়ী গনজালেস পিজারো একটি ছোট সৈন্যদল নিয়ে ইকুয়েডরের কুইটো থেকে এল ডোরাডো শহরের সন্ধান শুরু করেন। কিন্তু খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়ে গনজালেস পিজারো বলেন, এল ডোরাডো আসলে মানুষ নয় বরং এটি একটি হ্রদ। কিন্তু ইতিহাসবিদ পেড্রো দে সিজা দে লিওন ওই অভিযানের বর্ণনা দিয়ে এল ডোরাডোকে একটি উপত্যকা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। প্রায় শ’তিনেক সঙ্গী নিয়ে অভিযানটি শুরু করেছিলেন পিজারো। কুইটো থেকে পূর দিকে রওনা হন তিনি। সঙ্গে আরো ছিলো চার হাজার স্থানীয় দাস, ঘোড়া, লামা, দুই হাজার শূকর ও আরো হাজার দুয়েক শিকারি কুকুর। পিজারো ভেবেছিলেন, তারা শীঘ্রই খোলা জমি, চাষের মাঠ, গ্রাম ও শহরসহ এল ডোরাডো সভ্যতা খুঁজে পাবেন। আর এটা বের করতে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। কিন্তু বর্ষাকাল নামার সঙ্গে সঙ্গেই রেইনফরেস্টে অন্ধকারে প্রচণ্ড বিপদে পড়ে যান পিজারো। জঙ্গলের মধ্যে কয়েক মাস এলোমেলো ঘোরেন তারা। লেখক সিজা ডি লিওন উল্লেখ করেছেন, বিরূপ পরিস্থিতিতে পাহাড়, জলাভূমি ও নদীর মধ্যে পথচলার সময় কষ্ট, দুর্ভিক্ষ ও দুর্দশা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাননি পিজারো। অভিযানের সময় ওই অঞ্চলে প্রচণ্ড সহিংসতা চালান গনজালেস পিজারো। স্প্যানিয়ার্ডরা তাদের যাত্রা পথে স্থানীয় লোকজনকে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। যখন তারা পিজারোর মনের মতো উত্তর দিতে পারেনি, তখন তাদের ওপর নির্মম ও নির্দয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছিলো। বছর ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পিজারোর রসদ সরবরাহও কমে আসছিলো। অভিযানে নিয়ে যাওয়া পশুগুলো মারা যাওয়া শুরু করে, কমে আসছিলো খাদ্য সামগ্রীর মজুদ। এরি মধ্যে উত্তর ইকুয়েডরের কোকা নদীতে পৌঁছানোর পর, তারা ডেলিকোলা নামে স্থানীয় এক আদিবাসী প্রধানের কাছে থেকে এল ডোরাডো সম্পর্কে ভুল তথ্য পায় এবং এর ফলস্বরূপ গভীর বনে হারিয়ে যায় পিজারোর বাহিনী। পিজারোর সৈন্যদের একজন ছিলেন ফ্রান্সিসকো দে ওরেলানা। বনের মধ্যে দিশেহারা হয়ে ঘোরার সময় ওরেলানা একটি নৌকা ও প্রায় ৫০ জন লোককে খাবারের সন্ধানে বের হন। যাওয়ার আগে তিনি পিজারোকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাদ্যদ্রব্য নিয়ে ফিরে আনবেন। যদিও ওরেলানা খাবার খুঁজে পেয়েছিলো, কিন্তু সে আর পিজারোর কাছে ফিরে আসেননি। ‘এক্সপিডিশোন ইন্টু দা ভালি অফ দা অ্যামাজন’ বইয়ে লেখা হয়েছে, খাবার সংগ্রহে বেরিয়ে ওরেলানা ও তার সৈন্যরাই আমাজন আবিষ্কার করে ফেলেন। তখন তারা অ্যামাজনকে জানতেন মারাওন নামে। কয়েক মাস অ্যামাজানের গহীনে ঘুরে এ সময় তারা আটলান্টিকে মহাসড়কে গিয়ে পড়েন। আর এদিকে কয়েকমাসের চেষ্টায় কোনোমতে কুইটোতে পৌঁছান পিজারো। আর এরি সাথে শেষ হয় পিজারোর এল ডোরাডো অভিযান। রেলির অভিযান এল ডোরাডোর সন্ধানে গায়ানাতে দুবার অভিযানে বেরিয়েছিলেন ইংরেজ রাজসভাসদ স্যার ওয়াল্টার রেলি। ১৬১৭ সালের ১২ই জুন প্লাইমাউথ থেকে রেলি রওনা দেন। তার অধীনে ১৪টি জাহাজ ছিলো। সঙ্গে ছিলেন তার একজন কমান্ডার ও ছেলে ওয়াট রেলি ছিলেন। কিন্তু এই যাত্রা তাদের জন্য মোটেও শুভকর হয়নি। শুরু থেকেই নানা বিপদ আপদ ভর করে তাদের ওপর। আটলান্টিক সমুদ্রযাত্রায় অসুস্থতার কারণে রেলির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড জন পিগটসহ ৪২ জন প্রাণ হারান। রেলি নিজেও মাথায় আঘাত পান। সমুদ্র যাত্রার পীড়ার কারণে ২০ দিনের বেশি শক্ত খাবার খেতে পারেননি রেলি। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে যখন নৌবহরটি দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে এসে পৌঁছায়, তখন স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিলো যে, রেলি আর অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ায় রেলির জায়গায় তার কমান্ডার কিমিস দায়িত্ব নেন। কিমিসের অধীনে রেলির ছেলে ওয়াটসহ পাঁচজন ক্যাপ্টেন ও পাঁচজন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। তাদের সেই অভিযানে যোগ দেয় প্রায় ৪০০ জন। ১৬১৭ সালে ওরিনোকো নদীতে দ্বিতীয় অভিযানের সময় কিমিসের সঙ্গে পাঠানো হয় ওয়াল্টার রেলির ছেলে ওয়াটকে। বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেই অভিযানে রেলি নিজে যোগ দিতে পারেনি। তিনি ত্রিনিদাদ দ্বীপের একটি বেস ক্যাম্পে বিশ্রামে থাকেন। ওরিনোকো নদীতে কিমিসের সেই অভিযান বিপর্যয় বয়ে আনে। স্প্যানিয়ার্ডদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ওয়াট রেলি নিহত হন। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে ওয়াল্টার রেলি কিসিমসহ অন্যদের ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ছেলের মৃত্যুর দায় চাপান কিমিসের ওপর। জর্জিয়ার মার্সার ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ এরিক ক্লিংজেলহোফার বলেন, ওয়াল্টার রেলির অভিযোগ সহ্য না করতে পেরে কিমিস নিজ কেবিনে গিয়ে আত্মহত্যা করেন। ছেলের মৃত্যু ও অসফল এক অভিযানের পর আবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন রেলি। আর তিনি ফেরার পরই তাকে শিরোচ্ছেদের আদেশ দেন রাজা জেমস। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি অহেতুক স্প্যানিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। শেষ কথা দুঃখজনকভাবে এতো সব মর্মান্তিক ঐতিহাসিক ঘটনার পরও মানুষ এখনো সেই এল ডোরাডোর স্বর্ণের খোঁজ করে যাচ্ছে। আর এতে উৎসাহ জুগিয়েছে ইউরোপীয়দের সব লোমহর্ষক অভিযানের গল্প। সেখান থেকে অনেক লুটেরাদের মনে স্বর্ণের খনি নিয়ে তৈরি হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা। ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপীয় বিজয়ীদের মতোই এখনকারও আধুনিক লুটেরাও এল ডোরাডোর স্বর্ণের খোঁজে ধ্বংস করে চলেছে দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসকে। কলম্বিয়ার বোগোটার মিউজেও দেল ওরো বা স্বর্ণের জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিরলসভাবে এই সব লুটপাটের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু এল ডোরাডোর সন্ধানে নেমে স্বর্ণ মিলেছে অন্য জায়গাতে। আধুনিক স্বর্ণ লুটেরারাই কলম্বিয়াতে এতো পরিমাণে স্বর্ণ উন্মোচিত করে, যা রীতিমতো এখন বিস্ময়কর। ১৯৭০-এর দশকে যখন উত্তর কলম্বিয়ায় লুটেরাদের দ্বারা নতুন সাইটগুলি যখন সামনে আসতে থাকে তখন বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের বাজারে ধ্বংস নামে বাজারকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এল ডোরাডোর স্বর্ণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই লুটেরা গোষ্ঠী প্রাক-কলম্বিয়ান যুগের স্বর্ণের যেসব মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বের করে তা ছিলো অত্যন্ত মূল্যবান। কিন্তু লুটেরারা বাজারে বিক্রির জন্য স্বর্ণের প্রত্নবস্তুগুলো গলিয়ে ফেলায় সেসবের প্রকৃত মূল্য চিরতরে হারিয়ে গেছে। সৌভাগ্যবশত কলম্বিয়ার মিউজেও দেল ওরো এবং লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংগৃহীত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মূল্য সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে সহায়তা করে এবং এল ডোরাডোর কাহিনীর পিছনে যে সভ্যতা লুকিয়ে আছে সে সম্পর্কে কিছুটা হলেও ইঙ্গিত দেয়।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |