ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কার স্বার্থে
রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী
প্রকাশ: Saturday, 2 November, 2024, 4:03 PM
সর্বশেষ আপডেট: Saturday, 2 November, 2024, 4:12 PM

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কার স্বার্থে

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কার স্বার্থে

বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান আমলে দেখেছে মৌলিক গণতন্ত্র নামের অদ্ভুত এক গণতন্ত্র। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে পৌনে ষোলো বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর দেশে যখন সত্যিকারের সংসদীয় গণতন্ত্র চালুর আশা করা হচ্ছে, তখন তা বানচাল করতে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন ও নতুন ধরনের গণতন্ত্র চালুর দাবি জানাচ্ছে কিছু দল। যাদের মধ্যে জাতীয় পার্টি নামের বিতর্কিত দলও রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের অভিযোগ, ইসরায়েলি পদ্ধতির নির্বাচন চালু হলে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। কোনো দলের পক্ষে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সংসদ সদস্যদের কিনে সরকার গঠন করা অথবা সরকারের পতন ঘটানো সহজ হয়ে দাঁড়াবে।

মনে হচ্ছে, বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এ দেশ যাতে কোনো দিন উঠে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা উঠেপড়ে লেগেছে। দেশে এমন নির্বাচনব্যবস্থা তারা চালু করতে চাচ্ছে, যাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বলে কিছু থাকবে না।

জাতীয় নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা কায়েম হলে ধরে নেওয়া যায় আনুমানিক এক বা দুই শতাংশ ভোটের ওপর যেসব দল ভোট পাবে তাদের আনুপাতিক হারে সংসদ আসনে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে দেশের ৩০০ আসনে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে- সংখ্যানুপাতিক হারে জাতীয় সংসদের আসন বণ্টন করা হবে।

বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এ দেশ যাতে কোনো দিন উঠে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা উঠেপড়ে লেগেছে। দেশে এমন নির্বাচনব্যবস্থা তারা চালু করতে চাচ্ছে, যাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বলে কিছু থাকবে না

বলা হচ্ছে, ১৭০টি রাষ্ট্রের মধ্যে ৯১টিতে এ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের রীতি বাস্তবায়িত হচ্ছে। আমাদের দেশের বাস্তবতা হচ্ছে- দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পুরোপুরি ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের প্রক্রিয়ায় চলমান, সেই রাজনৈতিক কালচার এ দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের রক্তে-মজ্জায় মিশে গেছে। এখন নতুন করে কোনো বিতর্কিত ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা আমাদের রাষ্ট্রের সামনে নতুন সংকট সৃষ্টি করবে। যেখানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকার সাড়ে পনেরো বছরে বিশাল জঞ্জাল সৃষ্টি করে আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রটিকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে গেছে, সেসব সরিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারে প্রচুর সময়, শক্তি, অর্থ ব্যয়, মেধা-শ্রম খরচ করতে হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় মুখর। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ইতোমধ্যে প্রচলিত ব্যবস্থায় নির্বাচনের পক্ষে। আরও অনেক দল এ বক্তব্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

এরই মধ্যে দেশের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক কয়েকদিন আগে একটা প্রধান বাংলা দৈনিকে তার লেখা উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেছেন, এ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে পতিত ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলটির রাজনৈতিক পুনর্বাসনের পুরো সম্ভাবনা রয়েছে।

অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুযোগ পেতে পারে। তার বিশ্লেষণ অত্যন্ত মূল্যবান। এটা অবশ্যই ফ্যাসিবাদবিরোধী সাম্প্রতিক গণ অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক দলগুলো ও দেশের সচেতন নাগরিকদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

তারপরে বিবেচনায় নেওয়া দরকার- এ দেশে ৫৩ বছর ধরে ওয়েস্টমিনস্টার বা ব্রিটিশ পদ্ধতির সংসদীয় ব্যবস্থার প্রচলন নাগরিকদের মনে-মননে, মগজে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন হলে প্রথমত প্রতিটি আসনভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা আশ্রয়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হবেন। সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় সংসদ আসনভিত্তিক এলাকার জনগণের কাছে নিজের জবাবদিহিতা এবং সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের প্রতি জনসমর্থন কোনোটাই নিশ্চিত হবে না। বিশাল দূরত্ব তৈরি হবে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় ভোটারদের মাঝে। তাতে স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। সংসদে আসনভিত্তিক সদস্যের দায়বদ্ধতা অস্পষ্ট হয়ে পড়বে। সেই অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি একেবারেই নিচে নেমে আসবে, ভোটারদের মধ্যে স্থানীয় জনপ্রিয় ব্যক্তিদের প্রতি ভালোবাসা বা উভয়পক্ষীয় সৌহার্দ কোনোটাই আর থাকবে না। গণমানুষ ধরে নেবে- আমার ভোট তো একটা দল পাচ্ছে, আমার পছন্দের প্রার্থী পাবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই, তাই আমার ভোটের মূল্যই বা কী! তাতে এমনো দাঁড়াতে পারে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলো, নিরপেক্ষ হলো, কিন্তু ভোট পড়ল মোট ভোটারের পনেরো শতাংশ বা তারও চেয়ে কম। তখন সেই নির্বাচনটিকে কি কেউ প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক বলতে পারবেন?

একটা বড় বা ছোট দলের কোন কোন সদস্য সংসদে যাবেন সেটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও সংশ্লিষ্ট দলে কোন্দল সৃষ্টি হবে। ধরে নিলাম দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলটি সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ ভোট বা কাস্টেড ভোটের ৬০ শতাংশ পেল, তখন তাকে আনুপাতিক হারে মানে ১৮০টি আসন লাভের পরে ১৮০ জন সদস্য নির্ধারণ করতে হবে। তখন ওই দলের সংসদ সদস্য প্রার্থী ১০ হাজার ব্যক্তির মধ্যে প্রচণ্ড বাগ্বিতণ্ডা, সংঘর্ষ এমনকি অনেক জায়গায় ঘোরতর সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দেবে। একটা বড় দলের পক্ষে নির্বাচনের আগে প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া পরিচালনা এতটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়, যতটা হবে নির্বাচনে জেতার পরে আসন বণ্টন নিয়ে। আর নির্বাচনি প্রচারের সময়ে প্রধান প্রধান নেতারা, (যারা সংসদ সদস্য পদপ্রত্যাশী) তারা নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচনি প্রচারে সময়, শক্তি ও অর্থ খরচে, এমন কি মেধা-শ্রমদানে আগ্রহ দেখাবেন না, কারণ সেই ব্যক্তিবিশেষের সদস্য হওয়া বা না-হওয়া অনিশ্চিত থাকবে। এতে লাভবান হবে ক্যাডারভিত্তিক দুই তিনটি রাজনৈতিক দল। তারা একক প্রার্থীর যোগ্যতায় সারা দেশে এত দিন একটি আসন লাভের যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেননি, শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক আর ‘ইজমভিত্তিক’ কিছু বাণী প্রচার করেন তারা, কিন্তু জনগণের মাঝে প্রকৃত জনপ্রিয়তা অর্জনের কোনো চেষ্টায় তারা নেই। তারা যেখানে নির্বাচনে একটা আসন পাওয়ার প্রত্যাশাও করতে পারেন না, সেখানে সংখ্যানুপাতিক জনপ্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা কায়েম হলে দুটি বা তিনটি বড় জোর পাঁচটি আসন পেতে পারেন। আর ধর্মভিত্তিক একটি প্রধান রাজনৈতিক দল (যারা ধর্মভিত্তিক সংবিধানের উদ্ভট-তত্ত্বের পক্ষের শক্তি- যা বিশ্বের কোনো মুসলিম রাষ্ট্রেই নেই) মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার রাজনীতির দ্বারা রাষ্ট্রকে আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও সুশাসনের কল্যাণ-রাষ্ট্র হওয়ার পথে বাধা, তারা হয়তো পনেরো বা কুড়ি শতাংশ আসন পেয়ে যেতে পারে। আর পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ এর সুবিধা নিয়ে আবার নির্বাচনে জিতে আসার সুযোগ পাবে।

এমনকি ছাত্রলীগের মতো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেও তখন পার পাওয়া যাবে না। তাদের ঠেকানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের সাড়ে ১৫ বছরের লুটপাট করা কয়েক লাখ কোটি টাকার মাত্র দশ শতাংশ ব্যয় করে ভোট কিনে নির্বাচনের রায় নিজেদের পক্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

নতুন সেই সংখ্যানুপাতিক জনপ্রতিনিধিত্ব কায়েম হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ প্রার্থী হতে চান তাদের কী ব্যবস্থা হবে? তারা তো একজন দুজন নয়, সারা দেশের ৩০০ আসনে অন্তত ১ হাজার প্রার্থী দাঁড়াতে চাইতে পারেন।

তাদের নতুন এই বিধানে কীভাবে সুযোগ দেবেন? সংখ্যানুপাতিক জনপ্রতিনিধিত্ব বিধান তো তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগই দিতে পারবে না। বর্তমানে প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থায় নিরপেক্ষ বা নির্দলীয় প্রার্থীদের পঞ্চাশজনও তো পাস করে আসতে পারেন, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ বঞ্চিত করা তো তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, এমন কি মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার হরণ করার শামিল হবে।

আসল কথা হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা আগের অবস্থায় রেখেই অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজতে হবে। কোনো ধরনের নতুন বিতর্কিত ব্যবস্থা সৃষ্টির দ্বারা নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় প্রার্থীদের অধিকার লঙ্ঘন না করেই বড় দলের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি না করেই দেশে গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরির প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্র বজায় রাখা গেলে, দুর্নীতির প্রশ্রয় না দেওয়া হলে, আর ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সব অপরাধ-অপকর্ম-দুর্নীতির নজির থেকে শিক্ষা নেওয়া হলে দেশে আর স্বৈরাচার আসবে না, আর কোনো ফ্যাসিস্ট সৃষ্টি হবে না। [অবশ্যই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গণহত্যাযজ্ঞসহ আওয়ামী গডফাদারসহ এই ‘মাফিয়া-দলটির’ অপরাধীর বিচার ও শাস্তিদান নিশ্চিত করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে, তার ফলে নতুন ফ্যাসিস্ট আর তৈরি হওয়ার দুঃসাহস দেখাবে না অন্য কেউ]।

আমরা বিনীতভাবে সুনাগরিকদের কাছে আবেদন জানাব- তারা যেন মতলববাজ দলগুলোর এই ‘সংখ্যানুপাতিক জনপ্রতিনিধিত্বর ফাঁদে পা না দেন, প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থা অর্থাৎ প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু এবং নির্ভয়ে ভোটদানের সুযোগ সৃষ্টির পক্ষে দাঁড়ান। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে আর পরীক্ষানিরীক্ষা চায় না। যুগ যুগ ধরে তারা যে নির্বাচনব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত, সেই ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের পথে চলতে চায়। নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে যারা বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, তারা প্রকারান্তরে পতিত স্বৈরাতন্ত্রের জন্য সুবিধা করে দিচ্ছেন কি না ভেবে দেখতে হবে। অযথা পরীক্ষানিরীক্ষা নয়, দেশবাসী তাদের চিরচেনা নির্বাচনব্যবস্থা ফিরে পেতে চায়।

লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক

� পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ �







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: [email protected]
কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status