ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
সরকার বদল, এর পর কী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: Saturday, 2 November, 2024, 3:24 PM

সরকার বদল, এর পর কী

সরকার বদল, এর পর কী

পদত্যাগকারী ‘লৌহমানবী’ প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন শাসকদের পুরনো ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতি প্রয়োগ করতে, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের বহুল ব্যবহৃত বিভাজনটা নতুন করে সামনে নিয়ে আসতে। এক বিকালে সংবাদ সম্মেলনে তিনি যখন আন্দোলনকারীদের প্রকারান্তে রাজাকারের নাতি-পুতি বলে ফেললেন তখন তারুণ্য আর বাঁধ মানেনি, মধ্যরাতেই শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসেছে। ছাত্রীরাও আওয়াজ তুলেছে আবাসিক হল-হোস্টেলে : ‘চাইতে এলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ আর এই যে মধ্যরাতে শত শত ছেলেমেয়ে সাহস করে সরবে বের হয়ে এলো তার কারণ শুধু যে কোটা সংস্কারের ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার তা নয়, প্রধান কারণ তরুণের অন্যায়বিরোধী বিদ্রোহী-চেতনা। রাষ্ট্রের শাসকরা মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। তরুণ দেখেছে। তরুণদের জন্য সবচেয়ে বড় অত্যাচারটা ছিল অপমান। তরুণরা অপমানিত হচ্ছিল। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের পদে পদে অপমানিত করত। দমিয়ে-দাবিয়ে রাখত। অনবরত ভয় দেখাত। বস্তুত ভয়ের একটি সর্বগ্রাসী সংস্কৃতিই তারা গড়ে তুলেছিল। রাজাকার বলে গাল পাড়ার ঘটনা তরুণদের আত্মসম্মানবোধে তপ্ত বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারুণ্য ভয়ের সংস্কৃতির নিষেধাজ্ঞা ভেঙে ফেলেছে। এটা সেই তারুণ্য যাকে দেখা গিয়েছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মধ্যে, বুক পেতে যে দাঁড়িয়েছে পুলিশের সামনে। ওই তারুণ্য আমরা শহীদ নূর হোসেনের বুকে দেখেছি, দেখেছি শহীদ ডা. মিলনের ভেতরে। ঊনসত্তরে দেখতে পেয়েছিলাম শহীদ আসাদ ও শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহার মধ্যে। শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রীর নামের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে তার স্বৈরাচারী আচরণ। বলা হয়নি হাসিনা তুই কবে যাবি, বলা হয়েছে ‘স্বৈরাচার তুই কবে যাবি।’ হাসিনার সবচেয়ে বড় অপরাধ ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন। হাসিনা ছিলেন ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থারই প্রতিনিধি। আন্দোলন কোটা বিরোধিতায় সীমিত থাকেনি, হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বৈরাচারবিরোধী। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার নামও বদলে গিয়েছিল, বিবর্তিত হয়ে নাম নিয়েছিল ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলনের।


কেবল নামে নয়, চরিত্রেও আন্দোলন রূপ নিয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে। শুরু করেছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, এসে যোগ দিয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। এসেছে স্কুল, কলেজের ছেলেমেয়েরাও। সবাই বৈষম্যবিরোধী। কিন্তু কেবল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সীমিত থাকলে এই গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হতো না। সম্ভব হওয়ার কারণ এতে যোগ দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষও। উন্নয়নে তারা বঞ্চিত। শুধু বঞ্চিত নন, নির্মমভাবে নিষ্পেষিত। নিষ্পেষণের সেই নির্মমতাই নতুনভাবে প্রকাশ পেয়েছে ব্যাপক হারে মানুষ-হত্যায়।

আওয়ামী স্বৈরশাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল। জুলাই-আগস্টে পুলিশকে লেলিয়ে দেওয়া হয় নির্বিচারে মানুষ হত্যার কাজে। তারা সে কাজ করেছে। আওয়ামী দুর্বৃত্তরাও যে গুলি করেনি তাও নয়, তবে তারাও কাজটা করেছে পুলিশের পাহারায়। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। যত বেশি বলপ্রয়োগ সহ্য করেছে তত বেশি সাহসী হয়ে উঠেছে তরুণরা। পুলিশের ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে একজন ছাত্রীর যে চ্যালেঞ্জ- ‘আমার ওপর দিয়ে চালান’, সে চ্যালেঞ্জ ছিল অসংখ্য ছেলেমেয়ের। পটুয়াখালীর সাগর গাজী ছিল এইচএসসি পরীক্ষার্থী, পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় সে এসেছিল ঢাকার উত্তরায় খালার বাড়িতে বেড়াতে। আগস্টের ৫ তারিখে বিজয় মিছিলে সে ছিল। ফ্লাইওভার থেকে সাদা পোশাক-পরা কিছু লোক মিছিলের ওপর গুলি ছুড়ছিল, একটি বুলেট সাগর গাজীর মাথার পেছন দিয়ে ঢুকে সামনে দিয়ে বের হয়ে যায়। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ফেসবুকে সে লিখেছিল, ‘যদি মারা যাই বিজয় পতাকা কবরে দিও। হয়তো লাশ হবো, নয়তো ইতিহাস হবো।’ হয় লাশ নয়তো ইতিহাস, এই প্রতিজ্ঞা অজস্র তরুণের ভেতর দেখা দিয়েছিল। বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এই তরুণরা ছিল অবদমিত, ক্ষমতাহীন, অপমানিত, হয়তো হতাশ; রাষ্ট্রশাসকরা তাদের ওইভাবেই রাখতে চেয়েছে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঐক্য তরুণদের অসামান্য রকমের সাহসী করে তোলে। এই সাহস তরুণরা একাত্তরে দেখিয়েছে, এত বছর পর আবারও দেখাল; একাত্তরের মতোই এবারও রাষ্ট্রই তাদের নিয়ে এলো ওই অবস্থানে, উদ্যত বন্দুকের মুখোমুখি। প্রমাণিত হলো যে, রাষ্ট্র অনেক দিক দিয়েই বদলেছে বটে তবে চরিত্রে বদলায়নি, বরং আগের তুলনায় অধিক স্বৈরাচারী, নিষ্ঠুর এবং বৈষম্যের উৎপাদক ও লালনকারী হয়ে উঠেছে। পুলিশ বাহিনীর এক সদস্য তার স্যারকে দেওয়া রিপোর্টে লিখেছেন, ‘গুলি মারি, মরে একটা। একটাই যায় সরে, বাকিরা যায় না। এটাই স্যার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।’ অবশ্যই। কিন্তু স্যাররা এটা বোঝেন না; বোঝেন না তাদের ওপরওয়ালারাও।

সবচেয়ে ওপরে যিনি ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তার দম্ভ বাড়তে বাড়তে হয়ে উঠেছিল আকাশচুম্বী। অধ্যাপক ইউনূসকে তিনি পদ্মার পানিতে ‘চুবাতে’ চেয়েছিলেন। খালেদা জিয়াকে চেয়েছেন ‘টুপ করে’ ওই পানিতে ফেলে দিতে। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমার বাসার পিওন ছিল, সে নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না।’ যেন গৌরবের ব্যাপার, যেন দম্ভোক্তি; তার আশপাশে থাকলে ঐন্দ্রজালিক স্পর্শে পিপীলিকাও কীভাবে হস্তি হয় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপস্থাপনা। ফুলে-ওঠা পিওনটি যে ধরা পড়েনি, নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পেরেছে, সেটা অবশ্য উল্লেখ করেননি, হয়তো সেটা নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর একটা বড়াই ছিল। হাজার হোক তার পিওন তো! বাপের বেটা! দম্ভ ভরে খালেদা জিয়াকে বলেছিলেন, ‘এতিমের টাকা-চোর।’ দেশে ব্যবস্থা নেইÑ এমন চিকিৎসার অনুমতির জন্য অসুস্থ মহিলার পক্ষে বিদেশে যাওয়ার অনুমতির জন্য দরখাস্ত করা হলে কেবল যে সবেগে নাকচ করে দিয়েছেন তা নয়, মন্তব্যও করেছিলেন, ‘বয়স তো আশির ওপরে, মৃত্যুর সময় হয়ে গেছে।’

এবারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। এমন সংখ্যায় ও দৃঢ়তায় মেয়েদের এর আগে কোনো আন্দোলনে দেখা যায়নি। সমাজের মেয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত বৈষম্যের শিকার। তারা যৌন হয়রানি তো বটেই, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের কবলেও পড়ে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাও তাদের জন্য নিরাপদ নয়। সেই মেয়েরা মধ্যরাতে মিছিল করবে, এ ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু সেটাই ঘটেছে। কারণ হচ্ছে আন্দোলন নারী-পুরুষে বৈষম্য লুপ্ত করে দিয়েছিল। সবাই ছিল সহযোদ্ধা।

চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল সামনে, কিন্তু সমাজে ও রাষ্ট্রে নানান রকমের বৈষম্য বিশেষভাবে আয়-রোজগারের, ধনসম্পত্তির যেসব বৈষম্য, সেগুলো বাড়ছে বৈ কমছে না। বিদ্রোহ ছিল সর্বত্রব্যাপ্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধেই। যে জন্য মেহনতি মানুষ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন এবং অনেকেই প্রাণও দিয়েছেন। ভুয়া উন্নয়ন বৈষম্য বৃদ্ধি করেছে, মানুষকে পরস্পরবিচ্ছিন্ন ও পারস্পরিক শত্রুতে পরিণত করতে ব্যস্ত রয়েছে। অভ্যুত্থান আসলে উন্নয়নের ওই পুঁজিবাদী ধারার বিরুদ্ধেই, যদিও কথাটা প্রকাশ্যে আসেনি। আসত যদি আন্দোলনের নেতৃত্ব বামপন্থি ছাত্রদের হাতে থাকত। সেটা তো ছিল না।

ছেলেদের সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হয়ে মেয়েরা একটি নয়, দুটি ভীতির শৃঙ্খলকে ভেঙেছে। প্রথমটি রাষ্ট্রীয়, দ্বিতীয়টি সামাজিক। দুহাজার চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পতিত প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্র ও সমাজে বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিকতাকে আরও উঁচুতে তোলার ও গভীরে প্রোথিত করার স্ব-আরোপিত দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নিজে তিনি দুর্দান্ত রকমের কর্তৃত্বপরায়ণ ছিলেন; আচরণ ছিল আগের দিনের জমিদারদের মতো এবং বাংলাদেশটাকে পারিবারিক জমিদারি হিসেবেই তিনি গণ্য করতেন, যে জমিদারি তিনি ‘পৈতৃক সম্পত্তি’ হিসেবে পেয়েছিলেন। তার প্রধান উপদেষ্টা ছিল তার পুত্র, যার ‘স্বপ্ন’ ছিল বাংলাদেশকে ডিজিটাল করবেন। সেই স্বপ্ন ‘বাস্তবায়ন’ সম্পন্ন করার পর আওয়াজ তুলেছিলেন স্মার্ট বাংলাদেশের। ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ বানানোর পাঁয়তারাতে টাকা খরচ হয়েছে অঢেল, ফল পাওয়া গেছে সামান্য। তবে ওই প্রক্রিয়ায় প্রথমে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, পরে নাম বদলে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নাগরিকদের জন্য যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছিল সেটা ছিল তুলনাহীন। স্মার্টনেসের মাধ্যমে মানুষের যন্ত্রণা বৃদ্ধির নতুনতর ফন্দি হয়তো আঁটছিলেন। অতিষ্ঠ পাবলিক তার আগেই ধাওয়া দিয়েছে। তাদের কাজটা তাই অসমাপ্তই রয়ে গেল।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

� পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ �







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: [email protected]
কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status