ডাকাতিয়ার কান্না থামাবে কে?
এম এস দোহা
|
মনে হয় বড়ই অভাগা ডাকাতিয়া। জন্মের পর থেকে তার নাম নিয়ে শুরু হয় নেতিবাচক ভাবমূর্তি। দেশে সুন্দর সুন্দর নাম ধারণ করে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদী। এসব নদীর নামে গড়ে উঠেছে বহু শহর–বন্দর, জনপদ। হয়েছে সিনেমা, নাটক, যাত্রাপালা। দেশে বহু বড় বড় শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এসব নদীর নাম ধারণ করে। মধুমতি, কর্ণফুলী, যমুনা, পদ্মা, নরসুন্দা, গোমতী, সিন্ধু, নর্মদা, পিপাসা, কংস, ময়ূরক্ষী, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, সাঙ্গু,আত্রাই, মহানন্দা, সুরমা, কুশিয়ারা ইত্যাদি। এর সাথে ডাকাতিয়া নামটি বড্ড বেমানান। নামকরণের মাঝে ডাকাতিয়াকে অনেকেই অপরাধ ও অপরাধীর কাতারে মিলাতে চান। যা এখন স্বভাব -চরিত্রে অনেকটা মিলে গেছে। নদীটি এখন জনগণের গলায় কাটায় রূপ নেওয়ার পথে। গ্রীষ্মকালে নেই পানির প্রবাহ। ভূমি দস্যদের কবলে পড়ে একসময় খরস্রোতা ডাকাতিয়া পরিণত হয় খালে। শিল্প- কারখানা ও মানব সৃষ্ট বর্জ্য প্রবাহের অন্যতম ধারক হয়েছে নদীটি। ময়লা ও বর্জ্যের দুর্গন্ধে নদী-পাড়ের বাসিন্দারা রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। বিষাক্ত বর্জ্যের গন্ধে চলাফেরা করাটাও দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ দূরাবস্থায় ডাকাতিয়া নদীর নিরব কান্না ছাড়া আর কিছু করার আছে কি? ডাকাতিয়া নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরায়। উৎস ভূমি থেকে কুমিল্লা- লাকসাম- মনোহরগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরের পদ্মা- মেঘনার সংযোগে ও সঙ্গমে মিলিত হয়ে অনন্য ও অনুপম সৌন্দর্যের অংশীদার এ নদী। পর্যটকরা আসেন চাঁদপুরের এই মোহনায় পদ্মা -মেঘনার বিপুল জলরাশির নিরন্তর বৈরী আচরণ ও বিচিত্র ভঙ্গিমা অবলোচন করতে।এই মহনায় স্পষ্ট দেখা যায় দুই নদীর পানির ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। একটির পানি ঘোলাটে। অন্যটি অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ।সাক্ষী হিসেবে এই মহনায় ডাকাতিয়ার অবস্থান সুস্পষ্ট হলেও বড় নদী দুটির তান্ডবের কাছে অসহায়। আমার জন্ম, শৈশব, কৈশর, ডাকাতিয়া নদীর তীরবর্তী এলাকা লাকসামের বাতাখালীতে। বছরজুড়ে দেখেছি ডাকাতিয়ার বহতা কখনো স্রোতস্বিনী কখনো স্থবির। মাঝে মাঝে দেখেছি এক বুক কচুরিপানা নিয়ে ধীরে লয়ে চলতে। নৌকা, লঞ্চ চলাচলের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার সেতুবন্ধন ছিল নদীটি। নৌকা বাইচ, সাঁতার প্রতিযোগিতা, মৎস্য শিকারের অসংখ্য সুখকর স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে।লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজারের সুখ্যাতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারতা ছিল নদীটিকে ঘিরে। ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটি ২৩ কিলোমিটার কুমিল্লা সদর আর লাকসাম- মনোহরগঞ্জে ১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত।এক সময়ে কুমিল্লা- লাকসাম- চাঁদপুর- নোয়াখালী- লক্ষীপুর ইত্যাদি এলাকায় যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল ডাকাতিয়া নদী। ব্রিটিশ আমলে ডাকাতিয়া দিয়ে গোমতী তারপর তিতাস হয়ে ভাটি বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত যাতায়াত করা যেতো। নদীটি বর্ষাকালে এত উত্তাল ও প্রমত্ত ও সর্বগ্রাসী ছিল যা কৃষককুলের সর্বনাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা অনেকটা ডাকাতির শামিল। এমন জনশ্রুতি থেকেই ডাকাতিয়া নামের প্রচলন। ডাকাতিয়া নদীর মাছ ছিল দারুণ সুস্বাদু। প্রচুর বোয়াল মাছ পাওয়া যেত নদীটিতে। শীতকালে সৌখিন মৎস্য শিকারীরা দূর-দূরান্ত থেকে দলবেঁধে আসতো বোয়াল মাছ শিকারে। যা এখন শুধু স্মৃতি আর ইতিহাস। কারণ নদীটির পানি এখন এতই বিষাক্ত ও দূষিত যে মৎস্য বসবাস অসাধ্য। এই নদীর পানি ব্যবহার তো দূরে থাকলো চাষাবাদের জন্যও অযোগ্য। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক রিপোর্ট দেখা যায় কুমিল্লা আদর্শ সদর (সিটি কর্পোরেশন), সদর দক্ষিণ ও লাকসাম শহরের সুয়ারেজ, শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, গরু ও মুরগি খামারের বর্জ্য, গৃহস্থালির পানি বিভিন্ন খালের মাধ্যমে ডাকাতিয়া নদীতে পতিত। এসব বর্জে¨ খাল ও নদীর নব্যতা হ্রাস পেয়েছে। কমে গেছে পানির স্রোত। ব্যাপকভাবে বেড়েছে নদীর তীরবর্তী এলাকার দুর্গন্ধ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করলেও আশানুরূপ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন, লাকসাম পৌরসভা সহ নদীর তীরবর্তী ইউনিয়ন পরিষদ গুলোর সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকায় ডাকাতিয়ার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না| নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর স্মৃতি বিজড়িত পশ্চিমগাঁও বাড়িটি ডাকাতিয়া নদী বেষ্টিত। নদীর সৌন্দর্য উপভোগ ও মুক্ত বাতাসের স্বাদ গ্রহনের জন্যই অধিকাংশ রাজা,বাদশা,জমিদারদের বাড়িগুলো নদীর তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত। পূর্ণিমার রাতে নদীর পানির আলোকঝলকানী, পালতোলা নৌকা, মাঝি মাল্লাদের জারি- সারি গান ছিল তাদের চিত্তবিনোদনের উপভোগ্য। নদীর তীরবর্তী এলাকায় দূর্গন্ধে ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করবে জানলে তারাও ভুলে নদীর পাড়ে বাড়িগুলো নির্মাণ করতেন না। ওয়াব ফয়জুন্নেছার জন্ম, শৈশব, কৈশর, বেড়ে ওঠা ডাকাতিয়া নদী বেষ্টিত এই পশ্চিমগাঁয়ে। তাই পরবর্তীতে নদীর প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে তিনি বসবাসের জন্য বাড়িটিও নির্মাণ করেছেন একেবারে এই নদীর পাড়ে। ঐতিহাসিক বাড়ি এই বাড়িটির সৌন্দর্য ডাকাতিয়া নদীর কারণে এখন অনেক দৃষ্টিনন্দন ও মনমুগ্ধকর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ভূমিদস্যুদের নদীদস্যদের দখলও তত্ত্বাবধানের অভাবে এই নদীটি এখন মরা খালে উপনীত হয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মত লাকসাম মনোহরগঞ্জের খালগুলোও অস্তিত্ব এখন হারানোর পথে। অধিকাংশ খাল চলে গেছে অবৈধ দখলদারদের কবলে। যার কুফল এ ব্যাপারে বন্যায় দেশের পূর্ব দক্ষিণ অঞ্চলের ১১ টি জেলার মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে। নব্যতা হারা ডাকাতিয়ার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। পানিবন্দি হয় কোটি কোটি মানুষ। কারণ গ্রাম খালগুলো ইতিমধ্যে দখলে চলে যাওয়ায় নদীতে পানি নামার পথ বন্ধ। এখনো অনেক বিভিন্ন গ্রামে মানুষ পানিবন্দী। তাই সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার খাল খনন কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে সাধারণ মানুষ। এজন্য প্রয়োজন খাল গুলো উদ্ধারে উপজেলা পর্যায়ে এসিল্যান্ড অফিসের সঠিক তৎপরতার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা। দরকার ডাকাতিয়া নদীর নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিং, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও পরিবেশ দুষণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ডাকাতিয়া নদীর এই কান্না থামাতে এ পর্যন্ত বহুবার সমীক্ষা করেছে। গত বছরও একটি সমীক্ষা ও প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠালে তা ফাইল বন্দি। পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লা অফিস ডাকাতিয়া দুষণ রোধে শুধুমাত্র প্রতিবেদন আর তদন্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দৃশ্যমান কোন অ্যাকশনে যেতে পারেনি। ডাকাতিয়ারার এই কান্না থামতে উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসানের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ অত্যাবশক। |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |