|
বাংলাদেশে ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণ কী?
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
![]() বাংলাদেশে ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণ কী? শুক্রবার কম্পনটির কেন্দ্র ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে। এরপর একে একে সাভারের বাইপাইল, নরসিংদী ও রাজধানীর বাড্ডায় সৃষ্ট কম্পনগুলো বুঝিয়ে দিয়েছে, ভূমিকম্পের জন্য এখন আর প্রতিবেশী দেশ ভারত বা মিয়ানমারের দিকে তাকিয়ে থাকার দিন শেষ। বরং বাংলাদেশ নিজেই এখন ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলে পরিণত হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর বাংলাদেশ ও এর আশপাশে অনুভূত হওয়া একাধিক ভূমিকম্প এই অঞ্চলের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ারই ইঙ্গিত দেয়। ভূবিজ্ঞানীরা ২১ নভেম্বরের এই কম্পনকে বলছেন 'ইন্ট্রাপ্লেট'। সহজ ভাষায় বললে, টেকটোনিক প্লেটের সীমানায় নয়, বরং ভারতীয় প্লেটের ভেতরের কোনো ফাটল বা চ্যুতি থেকে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি। ঐতিহাসিকভাবে অতীতে এ অঞ্চলে যেসব বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, তার বেশিরভাগের উৎস ছিল দেশের বাইরে, যেমন—১৮৯৭ সালের 'গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক' বা ১৯৫০ সালের আসাম-তিব্বত ভূমিকম্প। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অতীতেও কয়েক দফা শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ইতিহাস বলছে, ১৬৪২ সালের সিলেট ভূমিকম্পে কয়েকটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ১৭৬২ সালের চট্টগ্রাম-আরাকান ভূমিকম্প ছিল অঞ্চলের অন্যতম ভয়াবহ দুর্যোগ। এতে শুধু ঢাকাতেই প্রায় ৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে। বহু গ্রাম পানিতে ডুবে যায়, নদীতে দেখা দেয় অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাস। শোনা যায়, ওই কম্পনের কারণে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে অগ্ন্যুৎপাতের মতো ঘটনাও ঘটেছিল। এরপর ১৭৭৫ ও ১৮১২ সালের কম্পনে ঢাকা ও সিলেট কেঁপে উঠলেও বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ১৮৬৫ সালে সীতাকুণ্ডে ভূমিকম্পে মাটি ফেটে বালু ও কাদা বেরিয়ে আসে। ১৮৮৫ সালের প্রায় ৭ মাত্রার 'বেঙ্গল ভূমিকম্প' (মানিকগঞ্জ) এবং ১৯১৮ সালের ৭.৬ মাত্রার শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পে একাধিক জেলায় বড় ধরনের কাঠামোগত ক্ষতি হয়। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, দেশের ভেতরে ভূগর্ভস্থ চাপ এখনও সক্রিয় রয়েছে। অতীতেও এ ধরনের কম্পনের নজির আছে। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প এবং ১৯৯৯ সালে মহেশখালীতে ৫.২ মাত্রার কম্পন স্থানীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছিল। নরসিংদী–মাধবদীর সাম্প্রতিক ভূমিকম্পটিও দেশের অভ্যন্তরীণ ফল্ট সিস্টেম, বিশেষ করে মধুপুর ফল্ট বরাবর সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূ–অভ্যন্তরে কী ঘটছে? ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ অবস্থিত তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে—ভারতীয় প্লেট, ইউরেশীয় প্লেট এবং বার্মা (মিয়ানমার) মাইক্রোপ্লেট। এ কারণেই অঞ্চলটি প্রকৃতিগতভাবে অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ। জিপিএস পরিমাপ দেখায়, দেশের বিভিন্ন চ্যুতি বা ফল্ট লাইন বছরে কয়েক মিলিমিটার করে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ ভূ–অভ্যন্তরে ক্রমাগত শক্তি জমা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল আরাকান সাবডাকশন জোনের কাছে অবস্থান করায় এ অঞ্চল স্বভাবগতভাবেই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এখানে ভারতীয় প্লেট ধীরে ধীরে বার্মা মাইক্রোপ্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, যা বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বাড়ায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ ফল্ট লাইন এবং নিকটবর্তী প্লেট সীমানা—দুইয়ের চাপই এখন সমানভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েকটি অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ—ডাউকি ফল্ট: সিলেট বিভাগ, ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জের একটি অংশ; মধুপুর ফল্ট: ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ মধ্যাঞ্চল; চট্টগ্রাম–মিয়ানমার প্লেট সীমানা: চট্টগ্রাম ও আশপাশের উপকূলীয় এলাকা। ভূ-অভ্যন্তরের গঠন কতটা উদ্বেগজনক? বাংলাদেশের নিচের টেকটোনিক কাঠামো বর্তমানে আরও স্পষ্টভাবে সক্রিয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভারতীয় প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একদিকে বার্মা মাইক্রোপ্লেটের নিচে ঢুকছে, অন্যদিকে ইউরেশীয় প্লেটকে ধাক্কা দিচ্ছে। এর ফলে বেঙ্গল বেসিনের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। এই চাপ ছড়িয়ে পড়ছে অভ্যন্তরীণ ফল্ট লাইনগুলো—মধুপুর, ডাউকি ও সিলেট–আসাম ফল্টেও। এই ফল্টগুলোর নড়াচড়া ভূপৃষ্ঠের খুব কাছে অগভীর ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। আর মধ্য বাংলাদেশের নরম পলিমাটির কারণে এ ধরনের কম্পন অনেক বেশি তীব্র অনুভূত হতে পারে। মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও তাই বড় ধরনের ক্ষতি ঘটাতে সক্ষম। যেহেতু এসব ভূমিকম্প প্লেটের ভেতরে ঘটে, তাই অনেক সময় কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ শহরেই তা আঘাত হানে, যা ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। ঢাকার মাটির গঠন ও স্থানীয় ভূপ্রকৃতি শহরটিকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও বেশি ঝুঁকিতে ফেলে। গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র–মেঘনা অববাহিকার জমাট বাঁধা নরম ও পুরু পলিমাটির ওপর দাঁড়ানো শহরটিতে ভূমিকম্পের তরঙ্গ প্রবেশ করলে এর গতি কমে যায়, কিন্তু শক্তি অনেকগুণ বেড়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় 'সাইট অ্যামপ্লিফিকেশন'। এর ফলে কম্পন দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী হয়, বিশেষ করে উঁচু ভবনের ওপরের তলাগুলোতে, যেখানে অনুরণন তৈরি হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। তাই এক এলাকায় সামান্য কাঁপুনি অনুভূত না হলেও অন্য এলাকায় বেশ তীব্র ঝাঁকুনি লাগতে পারে। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ঢাকার কিছু অঞ্চলের মাটি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে 'লিকুইফ্যাকশন' এর ঝুঁকি বাড়ছে—যেখানে ভূমিকম্পের সময় মাটি সাময়িকভাবে তরলের মতো আচরণ করতে পারে। এই অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। ঢাকার অবকাঠামোগত দুর্বলতা ভূমিকম্পের ঝুঁকি ভয়াবহভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক জরিপে কয়েক ডজন বহুতল ভবনকে বিপজ্জনকভাবে হেলে পড়া বা বড় ধরনের ফাটলযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্তত ৫০টি ভবনকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘোষণা করা হয়েছে, আর আরও বেশ কিছু ভবন সিলগালা বা খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভূমিকম্পে সরকারি অবকাঠামোর শক্তি ও সীমাবদ্ধতা—দুইটিই সামনে এসেছে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের কাঠামো ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি হলেও কম্পনের পর কিছু স্টেশনে ফাটল দেখা গেছে। এটি দেখায়—নকশাগত মান কতটা শক্তিশালী হোক না কেন, বাস্তব পরিস্থিতিতে কাঠামোর আচরণ ভিন্ন হতে পারে। পরিকল্পনা ও বাস্তবতার ফারাক এখানেই স্পষ্ট। এদিকে, সরু রাস্তা, ঘনবসতি, গায়ে গা লাগানো ভবন এবং খোলা জায়গার অভাবে ভূমিকম্পের পর নিরাপদে সরে যাওয়াও ছিল কঠিন। মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন বলছে, অনেক এলাকায় মানুষের জড়ো হওয়ার মতো নিরাপদ খোলা স্থানই ছিল না। ফলে মাঝারি মাত্রার একটি ভূমিকম্পও রাজধানীতে গুরুতর জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করে। ভূ-তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশ্ন শুধু টেকটোনিক প্লেটগুলো নড়েছে কি না, তা নয়; বরং এই সঞ্চালনের কারণে ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে, সেটিই মূল উদ্বেগ। টেকটোনিক প্লেটের ভেতরের ভূমিকম্পগুলো কিছুটা স্থানীয় চাপ প্রশমিত করে, কিন্তু একই সাথে শক্তি আশপাশের অন্য কোনো চ্যুতি বা 'লকড' অংশেও স্থানান্তরিত হতে পারে। বাংলাদেশ ইন্দো–বার্মা সাবডাকশন জোনের এমনই একটি বড় 'লকড' অংশের কাছে অবস্থিত। এই ভূকম্পনগত শূন্যস্থান বা 'সিসমিক গ্যাপ'-এ ফাটল ধরলে শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোমেনুল ইসলাম বলেছেন, 'এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় এর তীব্রতা বেশি অনুভূত হয়েছে। যদি কম্পনটি আরও পাঁচ থেকে সাত সেকেন্ড স্থায়ী হতো, ঢাকার বহু ভবন ধসে পড়ত।' অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবাইয়াত কবির বলেন, 'বাংলাদেশ ভারতীয় প্লেটের ওপর অবস্থিত। উত্তরে ইউরেশীয় প্লেট এবং পূর্বে মিয়ানমার প্লেট থাকায় এখানে প্রায়ই ভূমিকম্প ঘটে। যদিও আজকের মতো কম্পন ঘন ঘন হয় না, কিন্তু বড় ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তির সময়কাল বিবেচনা করলে, এই অঞ্চলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্যোগের আশঙ্কা থেকে যায়।' ঢাকার অবকাঠামোগত দুর্বলতা জরিপের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) জানায়, ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে এবং আরও দেড় লাখ ভবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে দুর্বল মাটির ওপর নির্মিত পুরনো ভবন ও বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি ছয়তলার বেশি ভবনগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ভূ-দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ও সাউথ এশিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সচিব মোহন কুমার দাস বলেন, 'বাংলাদেশ সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে এবং বর্তমানে বিশেষভাবে সংবেদনশীল অবস্থায় রয়েছে। দেশে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত ও পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। সঠিক পর্যবেক্ষণ থাকলে আমরা আগেভাগেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারতাম।' তিনি আরও বলেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পে হতাহতের বড় কারণ ছিল তাৎক্ষণিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। ফায়ার সার্ভিস, সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবকরা এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকার ঘন জনসংখ্যা, নিম্নমানের বহুতল ভবন, বস্তি, সরু রাস্তা এবং পানিসিক্ত মাটি শহরটিকে ভূমিকম্পে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পরিবহন খাতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় ৮৮.৭ কোটি ডলার এবং বিদ্যুৎ খাতে ২.৭১ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। জাপান বা ক্যালিফোর্নিয়ার মতো উচ্চ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশে জনসচেতনতা কম, জরুরি মহড়া নিয়মিত হয় না এবং কার্যকর দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থাও নেই। এ কারণে রাজধানী ঢাকা বড় ধরনের ভূমিকম্পে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। |
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
