কীভাবে 'ভালো তালেবান' হিসেবে পরিচিতি পেল গুল বাহাদুর গ্রুপের সদস্যরা?
নতুন সময় ডেস্ক
|
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি নিষিদ্ধ সংগঠনের তালিকায় দুটি 'জঙ্গি গোষ্ঠী'র নাম অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে, যার মধ্যে একটি হল 'গুল বাহাদুর গ্রুপ'। সে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মাজিদ ব্রিগেড এবং গুল বাহাদুর গ্রুপকে দুই বছর পর্যবেক্ষণ করার পর, পাকিস্তানের কাউন্টার টেরোরিজম অথরিটি তাদের নিষিদ্ধ দলের তালিকায় যুক্ত করেছে। দেশটির জাতীয় কাউন্টার-টেরোরিজম অথরিটি নিষিদ্ধ দলগুলোর যে তালিকা করেছে সেটা হাতে পেয়েছে বিবিসি। সেখানে দেখা যায়, গুল বাহাদুর গ্রুপের নাম ২০২৪ সালের ২৫শে জুলাই ওই তালিকায় যুক্ত করা হয়। এই সিদ্ধান্তের দশ দিন আগে, দেশটির খাইবার পাখতুনখোয়ার ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, যা কি না 'বান্নু ক্যান্ট' নামে পরিচিত সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা হয়। সেই হামলার দায় স্বীকার করে গুল বাহাদুর গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত জইশ ফারসান মুহাম্মাদ গোষ্ঠী। আইএসপিআর-এর তথ্য অনুসারে, ওই ঘটনায় দশ জন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী নিহত হয়। যাদের মধ্যে একজন গাড়ি-বোমা হামলাকারীও ছিল। কিন্তু গুল বাহাদুরের জঙ্গিবাদের ইতিহাস অনেক পুরনো, যা শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন ও নেটোর আগ্রাসনের সময় থেকে। এরপর একটা সময় ছিল যখন গুল বাহাদুর দলটির নাম পরিবর্তন করে 'গুড তালেবান' রাখা হয়। কেন না উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সক্রিয় এই দলটি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উপর কখনও হামলা চালায়নি। অথচ এখন এই জঙ্গি গোষ্ঠীর কমান্ডাররা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাজ্যের ইনফরমেশন ফর রেজিলিয়েন্স সেন্টারের আফগান ভেটেরান্স অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুসারে, হাফিজ গুল বাহাদুর নামের এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি ২০২৩ সালের মে মাস থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৪ মাসে ১০টি আত্মঘাতী হামলার দায় স্বীকার করেছে, যাতে মোট ২২ জন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী অংশ নিয়েছিল। এই গুল বাহাদুর কারা এবং কেন তাদের 'গুড তালেবান' নাম দেওয়া হয়েছিল, যেখানে তারা কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত তেহরিক-ই- তালেবান পাকিস্তানে (টিটিপি) যোগ দেয়নি? সেই সাথে আফগানিস্তানের তালেবানের হাক্কানি গ্রুপের সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন ছিল? এই নিবন্ধে সে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্ররা কীভাবে জঙ্গি হল? সাংবাদিক রসুল দাওয়ারের মতে, উত্তর ওয়াজিরিস্তানের বাসিন্দা ‘গুল বাহাদুর’ মাদ্রাসায় পড়া শেষে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। রসুল দাওয়ারের মতে, গুল বাহাদুর মূলত দেওবন্দ মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত পাকিস্তানের একটি প্রধান ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দল জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলামের মাওলানা ফজলুর রহমান গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সেই সাথে তিনি এই দলটির ছাত্র সংগঠনের উত্তর ওয়াজিরিস্তান শাখার প্রধানও ছিলেন। গুল বাহাদুরের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি, এমন কী তার একটি ছবিও প্রকাশ্যে পাওয়া যায় না। স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, গুল বাহাদুরের দুই স্ত্রী থাকলেও তাদের সন্তানের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। গুল বাহাদুরের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মতে, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর ২০০১ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জঙ্গিবাদের জগতে প্রবেশ করেন। সাংবাদিক রসুল দাওয়ারও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ২০০১ সালে, গুল বাহাদুর আফগানিস্তানে মার্কিন ও নেটো বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্থানীয় উপজাতীয় যোদ্ধাদের একত্র করেছিলেন, যাদের বলা হতো 'শুরি মুজাহিদিন'। ২০০১ সালের পর, পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় একের পর এক আফগান তালেবানপন্থী স্থানীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। তখন শুরি মুজাহিদিন উত্তর ওয়াজিরিস্তানে একটি গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীতে পরিণত হয় এবং তারা মূলত আফগান তালেবান এবং আল কায়েদা-সহ স্থানীয় এবং বিদেশি জঙ্গিদের সাথে লড়াই করতো। মিত্রদের আশ্রয় দিতো। উত্তর ওয়াজিরিস্তান ও হাক্কানি গ্রুপ আফগানিস্তানে নেটো বাহিনীর বিরুদ্ধে তালেবানদের পাল্টা অভিযান শুরু হলে উত্তর ওয়াজিরিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। ড. আসফান্দিয়ার মীরের মতে, আফগান তালেবানের উপপ্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানির সাথে গুল বাহাদুরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, হাক্কানিও উত্তর ওয়াজিরিস্তানে বসবাস করতেন। এই সুসম্পর্কের কারণেই গুল বাহাদুর আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলায় আল-কায়েদার যে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা নিহত হয়েছিলেন তাদের বেশির ভাগই ছিলেন উত্তর ওয়াজিরিস্তানে গুল বাহাদুরের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায়। বিশেষ করে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের দট্টা খেলা নামক জায়গায় তাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। মি. মীরের মতে, আল-কায়েদার বেশির ভাগ নেতা গুল বাহাদুরের বাড়িতেই অবস্থান করতেন। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, উত্তর ওয়াজিরিস্তান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার তিনটি প্রধান কারণ ছিল - এই অঞ্চলের ভৌগোলিকক অবস্থান তুলনামূলক সহজ, জঙ্গিগোষ্ঠী ও সরকারের মধ্যে ২০০৮ সালের শান্তি চুক্তি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল গুল বাহাদুরের ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তান সরকারের সাথে চুক্তি এক দিকে গুল বাহাদুর আল-কায়েদা নেতাদের আশ্রয় দিতেন এবং পাশাপাশি আফগানিস্তানে নেটো ও মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতেন। অন্য দিকে তিনি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে চুক্তিও করেন। এটি মাথায় রাখা জরুরি যে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তান সরকার এবং স্থানীয় তালেবানের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তিতে সব বিদেশি জঙ্গিকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করা, সেই সাথে তালেবান, আল-কায়েদা এবং তাদের সংশ্লিষ্ট সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে স্থানীয় তালেবান সম্মত হয়েছিল। তাদের এই আশ্বাসের ভিত্তিতে সরকার তালেবানের বিরুদ্ধে স্থল ও বিমান সামরিক অভিযান বন্ধ করে। পাশাপাশি তারা উপজাতি মানুষদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া এবং অভিযান চলাকালীন জব্দ করা সরঞ্জাম ফেরত দেওয়ারও ঘোষণা দেয়। এই চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান ছিল টার্গেট কিলিং অর্থাৎ নিশানা করে খুন করা নিষিদ্ধ করা, যা এই চুক্তিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। গুল বাহাদুর এবং মোল্লা নাজির গ্রুপ এই চুক্তির পক্ষে ছিলেন। এভাবে গুল বাহাদুর 'গুড তালেবান' হিসেবে পরিচিতি পেলেও এই চুক্তির কারণ মূলত ছিল কৌশলগত। সাংবাদিক ফয়জুল্লাহ খানের মতে, গুল বাহাদুর পাকিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার বিরোধী ছিলেন না, বরং তিনি আফগানিস্তানে মার্কিন ও তাদের মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই এড়িয়ে গিয়েছেন। গুল বাহাদুরের সতর্ক ভূমিকা এবং সরকারের সাথে চুক্তির প্রধান কারণ ছিল উত্তর ওয়াজিরিস্তানে জঙ্গিদের 'অভয়ারণ্য' বা নিরাপদ মুক্তাঞ্চল রক্ষা করা, যা আফগানিস্তানে যুদ্ধরত আফগান তালেবানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্য দিকে, গুল বাহাদুর পাকিস্তানে আল-কায়েদা এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সক্রিয় নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবানের হামলার বিরোধিতা করেননি। কিন্তু সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তি মেনে চলার ক্ষেত্রে গুল বাহাদুর উত্তর ওয়াজিরিস্তানে জঙ্গিদের হামলা বন্ধ করতে তৎপর ছিলেন। বিশেষ করে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে জঙ্গিদের আক্রমণ তিনি কঠোরভাবে দমিয়ে রেখেছিলেন। এর একটি নমুনা দেখা যায় ২০১১ সালে। যখন পাকিস্তানের তেহরিক-ই-তালেবানের বর্তমান প্রধান হাকিমুল্লাহ মেহসুদকে গ্রেফতার করতে নিরাপত্তা বাহিনী উত্তর ওয়াজিরিস্তানের রাজধানী মিরান শাহের কাছে একটি গোপন আস্তানায় অভিযান চালায়। মুফতি নূর ওয়ালি মেহসুদের ২০১৭ সালে লেখা বই 'ইনকিলাব মেহসুদ' বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে এ বিষয়ে জানা যায়। তেহরিক-ই-তালেবান-সহ অন্যান্য বহিরাগত জঙ্গিরা পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু গুল বাহাদুর তা হতে দেননি। এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তেহরিক-ই-তালেবানের একজন কমান্ডার। সাংবাদিক রাকিম আল-হারুফের সাথে ২০২৩ সালের প্রথম দিকের এক সাক্ষাতকারে ওই তালেবান কমান্ডার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওই কমান্ডার তার সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণের সময়, গুল বাহাদুর এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন এবং এসব হামলা নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার নিষেধ লঙ্ঘন করলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলেও তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। এই হুমকির ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে তালেবানদের প্রতিশোধমূলক কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। গুল বাহাদুর উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর যে কোনও হামলাকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেন। যাই হোক, একই সময়ে এই চুক্তিগুলো ভঙ্গ হতে থাকে এবং বহুবার গুল বাহাদুর গ্রুপ সরকারের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে পদক্ষেপ নেয়।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |