আপিল বিভাগের আদেশের পর কোটা বিরোধী আন্দোলন কতটা যৌক্তিক
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Wednesday, 10 July, 2024, 10:09 PM
আপিল বিভাগের আদেশের পর কোটা বিরোধী আন্দোলন কতটা যৌক্তিক
সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিল চেয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা।
বুধবার (১০ জুলাই) সকাল ১০টা থেকে রাস্তায় নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে ফিরে যেতে বলেছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কোনও বক্তব্য থাকলে আদালতে লিখিত আকারে জমা দিতে বলা হয়েছে। এই আদেশের পরও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কতটা যুক্তিযুক্ত বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং জনভোগান্তিরও কারন হতে পারে বলে ধারনা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার বিকালে সময়ের আলোকে বলেন, আদালতের আদেশের পরও তারা ঢাকা অচল করে দিয়েছে। সারাদেশের মানুষ ভোন্তির শিকার হচ্ছে। এর নেপথ্যে কেউ না কেউ উস্কানি দিচ্ছে। তবে আমরা সেটি খতিয়ে দেখছি।
এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, জনদুর্ভোগ ও সংঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে কি না এবং আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।
তিনি বলেন, ছাত্রছাত্রীদের বোঝা উচিত যেহেতু আদালত একটি আদেশ দিয়েছেন সেই আদেশকে মান্য করা। তাদের দাবিগুলো আদালতে তুলে ধরলে অবশ্যই আদালত তাদের কথা শুনবেন। জনদুর্ভোগ বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে কখনই সমাধান আসেনা। এর পেছনে কেউ না কেউ ইস্কানি দিচ্ছে। যদি দিয়েই থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে খুঁজে বের করা হবে।
আন্দোলনের প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বুধবার দুপুরে সময়ের আলোকে বলেন, আন্দোলনের নামে কেউ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাক এটা কাম্য নয়। তবে অবনতি ঘটনালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সারাদেশের পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আপিল বিভাগের বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে শুনেছি। আমাদের কাছে নির্দেশনা আসলে সে হিসেবে আমরা কাজ করবো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বুধবার সন্ধ্যায় সময়ের আলোকে বলেন, ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন করা ও স্থগিত করা নিয়ে আমার তেমন কিছু বলার নেই। কোটা বিরোধী আন্দোলন চলাকালে বুধবার আপিল বিভাগ আগামি এক মাসের জন্য স্থগতাদেশ দিয়েছেন। ফলে আগামী এক মাসে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও বিজ্ঞপ্তিতে কোথাও কোটার কথা উল্লেখ্য থাকবে না। ফলে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের যে দাবি ছিল সেটি পূরণ হয়েছে। যদিও একটা স্থায়ী সমাধানে আসেনি।
তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয় আদালতে যে আলোচনা হয়েছে, সেই সুযোগটা ছাত্রছাত্রীরা আদালতে সেগুলো তুলে ধরতে পারবে। যদি ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন স্থগিত রাখে তাহলে জনভোগান্তি হ্রাস পায় এবং তাদের অর্জনের দিকে এগিয়ে যায়। আন্দোলন স্থগিত করলে বিথায় যাচ্ছে ব্যপারটা এরকম না।
ঢাবির সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আরও বলেন, ছাত্রছাত্রীরা আদালতে মতামত তুলে ধরলে আদালতের জন্য সুবিধা হবে। তাদের জন্যও সুবিধা হবে।
নেপথ্যে কারও ইন্দন থাকতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি সেটা মনে করতে চাই না। তবে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না।
জানতে চাইলে গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক এমএ বারি বুধবার বিকালে সময়ের আলোকে বলেন, দেশের জন্য যুদ্ধকরা মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা বহাল রেখে অন্যান্য কোটা বাতিল করা উচিত। ধারাবাহিক আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আদালত যে রায় দিয়েছেন সেই রায়ের প্রতিও আন্দোলনকারীদের সম্মান রাখা জরুরি। কারণ আদালত যেহেতু এক মাসের সময় নিয়েছে সেটি অবশ্যই এই আন্দোলনের ফলপ্রসূ। একপর্যায়ে তাদের দাবি মেনে নেয়া। তবে আদালতের আদেশ অমান্য করে আন্দোলনের নামে রাস্তাঘাট বন্ধ করে জনভোগান্তিও কোনওভাবে কাম্য নয়।
আন্দোলনকারিরা এ্যাম্বুলেন্স, রোগীর পরিবহন, সংবাদপত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিবহনসহ জরুরি সেবার পরিবহন ছেড়ে দিলেও বাকিদের চলাচল করতে হচ্ছে হেঁটে। রাস্তা ধরে হাজারো মানুষ কেউ অফিস শেষে কেউ বা অন্য কাজ শেষে হেঁটে বাসায় ফিরছেন।
তাদের একজন জামিল হোসেন। ফার্মগেট মনিপুরী পাড়া একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ফার্মগেট বেরিকেড দেয়ায় খামারবাড়ি পর্যন্ত গাড়ি আটকে আছে। সেখান থেকে শাহবাগ হেঁটে আসলাম। কারণ সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত বাস পাবো না।
যাত্রী পরিবহন শ্রমিকেরা আছেন সন্ধ্যার অপেক্ষায়। অ্যাপ ভিত্তিক কার চালকেরা অনেকেই যানযটে আটকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। অ্যাপ ভিত্তিক কার চালক সুমন মোল্লা বলেন, দুই ঘণ্টা হলো সার্ক ফোয়ারার উল্টা পাশের রোডে আটকে আছি। ছাত্ররা যেতে দিচ্ছে না। এখন সন্ধ্যার অপেক্ষায় আছি। সন্ধ্যায় তারা ব্যারিকেড ছাড়লে শান্তিতে গাড়ি চালাতে পারবো।
মোহাম্মদপুর থেকে সবজির ভ্যান নিয়ে এক ঘণ্টা একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত মো. জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর থেইকা সবজি আইনা বাংলামোটর যাওয়ার রাস্তায় আইটকা আছি এক ঘণ্টা হলো। আন্দোলন শেষ না হওন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না যাইতে পারুম। বেশ কয়েকটি বাস চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও সকাল থেকে রাস্তায় বাস নামাননি। আছেন সন্ধ্যার অপেক্ষায়। আন্দোলন সন্ধ্যায় শেষ হলে বাস নামাবেন।
বসুন্ধরায় ভারতীয় ভিসা সেন্টারে ভিসার আবেদন করে গুলিস্তান ফিরছিলেন মো. কাইয়ুম। ফেরার পথে বাইক নিয়ে আটকা পড়েছেন কারওয়ান বাজার মোড়ে। তিনি বলেন, সরকার কোটার দাবির সমাধান করলেই হয়। তা না করায় মাঝখান দিয়ে আমাদের ভোগান্তি হচ্ছে কয়েক দিন ধরেই।
গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। বেলা সোয়া ৩টায় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে গুলিস্তানের উদ্দেশ্যে বের হন। এবং বেলা ৪টায় তারা জিরো পয়েন্টে পৌঁছায়। জিরো পয়েন্টে অবরোধটি ৩ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এসময় শাহবাগ, কাকরাইল, সদরঘাট, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ীগামী সড়কগুলোতে তীব্র যানজট লক্ষ্য করা যায়। বাবুবাজারের সড়কেও একই চিত্রের দেখা মিলে।
এবিষয়ে সদরঘাটগামী একটি বাস থেকে নামার সময় শাকিল আহমেদ নামে এক যাত্রী সময়ের আলোকে বলেন, হঠাৎ সদরঘাটের ওদিক থেকে একটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসার পর গুলিস্তানে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় আগে থেকেই যানবাহন কম ছিল তবে এ মিছিল আসার পর জিরো পয়েন্টে বাস আটকা পড়ে। আর আমাদের ভোগান্তি শুরু হয়।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেছেন আপিল বিভাগ। এ সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করতে বলেছেন আদালত। এ আদেশের ফলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র বহাল থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।