বেয়াদব 'দেশ' আজও মানুষ হয়নি
আবদুল হাই শিকদার
|
সম্প্রতি ভারতের 'দেশ' পত্রিকা বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি যে অসম্মান দেখিয়েছে , সে বিষয়ে কিছু বলার জন্য অনেকেই আমাকে অনুরোধ করেছেন । সেজন্যই নিচের খসড়া । ক. ৯২/৯৩ এর ঘটনা । ভারতের এই দেশের এক বিশেষ সংখ্যায় , নিরোদ সি চৌধুরীর তার লেখায় 'তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশ' বলে আমাদের মাতৃভূমি নিয়ে উপহাস করেছিলেন । বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে খুব আহত করেছিল । তিনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে । আমাদের আমতা আমতা করা দেখে বললেন , নিরোদ চৌধুরী বড় লেখক না ছোট বুদ্ধিজীবী এটা এখন বিচার্য নয় ।তিনি স্বাধীন বাংলাদেশকে অপমান করেছেন , তিনি বাংলাদেশের জনগণকে অসম্মান করেছেন ।এটা ধৃষ্টতা ,এর জবাব দেয়া আমাদের কর্তব্য । বাংলাদেশে দেশ নিষিদ্ধ হলো । চোরাই পথে আসার ছিদ্রগুলোও সংকুচিত হলো । এক ঘাড় ধাক্কায় দেশ সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিকে পতিত হলো । সেই পতন থেকে আজও মাজা সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি দেশ। কারণ এই অকৃতজ্ঞ পত্রিকাটির দপদপানি ছিল বাংলাদেশের মার্কেটের উপর নির্ভর করে । ৯৬ এ শেখ হাসিনার সরকার নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নিলে আবার বাংলাদেশে প্রবেশের মওকা পেয়ে যায় আনন্দবাজার গোষ্ঠীর এই ট্রয়ের ঘোড়া । কিছুদিন ভদ্রতা বজায় রেখে ফের শুরু করে তাদের নোংরামী । বাংলাদেশের জনগণকে অপদস্ত করার ভারতীয় কৌশলের যারা এদেশীয় কুশীলব , তাদের নানা শ্রী ও পুরষ্কারে ভূষিত করার কাজটি এই পত্রিকা পরিবার করে থাকে ।শিল্প সাহিত্য ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ লোকজন তৈরী করাও তাদের এজেন্ডা । জেনে বুঝে , উদ্দেশ্যমূলকভাবে , সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ হিসাবে , একটা উটকো ফেৎনা তৈরীর বদ মতলবে নজরুলের মতো এমন মহিমাময় শিল্প স্রষ্টাকে কবি জীবনানন্দের পায়ের নিচে বসিয়ে দিয়েছে । ওরা খুব ভালো করে জানে নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি । নজরুল বাংলাদেশের চিরসংগ্রামী চেতনার প্রতীক। তিনি বাংলাভাষার জাতীয় সাহিত্যের নির্মাতা । জাতীয় সংস্কৃতির মূল কারিগর । জীবনের জন্য যেমন দরকার আলো বাতাস খাদ্য ও পানি , বাংলাদেশের জন্যও সেই রকম প্রয়োজনীয় নজরুল । তিনি আমাদের সাহিত্যের অধিক সাহিত্য ।জীবনের অধিক জীবন । এর বিভাজন হয়না । ভারত ফারাক্ক দিয়ে গঙ্গার যতো পানি আটকে রেখেছে , তার চাইতেও লক্ষ গুণ আবেগ ও ভালোবাসা বাংলাদেশের হৃদয়ে জমা আছে নজরুলের জন্য । অনেক বড় বড় প্রতিভা থাকা সত্বেও ইরানের জন্য যেমন ফেরদৌসী , ব্রিটিশদের জন্য যেমন শেক্সপিয়র , আমেরিকার জন্য যেমন হুইটম্যান , পাকিস্তানের জন্য যেমন ইকবাল , ভারতের জাতীয় কবি যেমন রবীন্দ্রনাথ ( তাঁর অপরিহার্যতা মাথায় রেখেই বলছি ) তেমনি আমাদের জন্য নজরুল ।এমন কী তাদের সবার চেয়ে বেশী ।আমরা একটা আক্রান্ত ভূভাগে আছি।এই সংকটে জাতির বড় অবলম্বন তো তিনিই । — পাঠক আবেগতাড়িত না হয়ে আমি কী বলছি বোঝার চেষ্টা করুন । বাংলাদেশের ধর্ম , বর্ণ, গোত্র , ছোট বড় জাতি , উপজাতি নির্বিশেষে দৈশিক ও বৈশ্বিক সব ক্ষেত্রে সকল মানুষের জন্য সমান আতিথ্য নজরুল ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না । আমাদের জাতির আশা আকাঙ্খা স্বপ্ন সংগ্রামের তিনি সবচেয়ে প্রবল প্রতিনিধি , নায়ক । সাম্প্রদায়িকতা , শোষণ বন্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ গঠনের জন্য, মনোজগৎকে উদ্দীপ্ত ও সন্জীবিত রাখার জন্য নজরুলই তো উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় । আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সাহিত্য সঙ্গীত তথা জাতীয় সংস্কৃতির সব কিছু যে বিপুল সৌন্দর্য , ঔদার্য ও সামগ্রিকতা নিয়ে নজরুলে উদ্ভাসিত তার কি তুলনা হয় ? বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞান , শ্রমজীবীর ঘামের সঙ্গে মরমীবাদ , ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার যে জ্যোতির্ময় মিশ্রন নজরুলে , তা এক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোথায়ও নেই । ঙ . তারপরও দেশ এই অন্যায অন্যায্য কর্মটি করেছে । এই কাজটি হলো আধিপত্যবাদী চরিত্রের নগ্ন ইতরামী। এখানে সাহিত্যের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে , উপনিবেশবাদের উচ্ছিষ্টপীড়িত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হামলে পড়েছে নজরুলের উপর । নজরুলকে অসম্মান করে তারা এক ঢিলে তিন পাখি মারতে চেয়েছে , নজরুলকে জনগণের হৃদয়ের সম্মানের আসন থেকে উৎখাত করা , বাংলাদেশের অস্তিত্বকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে মানসিক পাটাতনকে দুর্বল করা ও আমাদের জনগণের গৌরবের দুর্গ গুড়িয়ে দিয়ে হীনম্মন্যতায় পর্যবসিত করা । ফলে ভারতীয় শ্রেষ্ঠত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার পথে আরও এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে । আর এখানে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে জীবনানন্দ দাশের মতো নিরাপরাধ , নির্বিবাদী ও নির্জনতা প্রিয় আমাদেরই এক প্রিয় কবিকে । ধূর্তামী আর কাকে বলে! বাংলা কবিতাকে শ্মশানে নেয়ার আয়োজক দেশের এই হারামীগিরির নিন্দা করবো কোন ভাষায়? চ. এই দেশআলাদের উৎসভূমি কোথায় ? এদের শ্রেণী চরিত্র কী ? ১৯৭১ সালে যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল সহজ ভাষায় তাদের আমরা রাজাকার বলি ।দেশআলারাও আসলে রাজাকার । ১৭৫৭ সালে এরা এরা ক্লাইভের দালালী করেছে ।মীরজাফর জগৎশেঠের সহগামী হয়েছে ।পলাশী বিপর্যয়ের আনন্দে কলকাতায় বিজয় মিছিল করেছে । ১৮৫৭ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষে নির্লজ্জ দালালী করেছে ।ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে ন্যাংটা হয়ে কলম চালিয়েছে ,সংহতি সমাবেশ করেছে।স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করেছে।ফাঁসি দাবী করেছে । সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে সমাজজীবনের সম্প্রীতি সমঝোতার মূলোৎপাটন করেছে। সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষের মতে এরা হলো নাবিক , বণিক ও লম্পট শ্রেণীভূক্ত । ভারতের বিশিষ্টজনদের কথায় এরা বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদের সমর্থক গদি মিডিয়া । আগে দালালী করতো ব্রিটিশদের, জমিদার মহাজনদের, এখন গু খায় 'র' এর, কাজ করে বিজেপির। ১. কবিতায় নজরুল যতো ছন্দ নিয়ে কাজ করেছেন , অতো কাজ আর কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি । ২. বিষয় বৈচিত্র্যে , স্বাদে , গন্ধে ,আঙ্গিকে , তাৎপর্যে তার বহুমুখীনতা তুলনাহীন ৩. সাম্রাজ্যবাদ , ঔপনিবেশবাদ , আধিপত্যবাদ , সাম্প্রদায়িকতা , পরাধীনতা , শোষণ বন্চনা বিরোধী সংগ্রামে নজরুলের ভূমিকা অবিস্মরণীয় ।এখানে তাঁর ভূমিকা অগ্রনায়কের । আধুনিকতার নামে উপনিবেশিক ভূষিমাল খেয়ে আত্মহারা তিরিশের দশকের কেরানী কবিদের অবস্থান এক্ষেত্রে কোথায় ? ৪. মানুষ , মানবতা , স্বাধীনতার জন্য নজরুলের চাইতে বেশী কাব্য সফলতা বিশ্ব ইতিহাসে আর আছে কি ? ৫. নজরুল বাংলাভাষার গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃত ।তার আগে সাংবাদিকতা ছিল আজকের মতোই পদলেহী। তার ধূমকেতু ও লাঙ্গলের মতো পত্রিকা আর কি কখনো করা গেছে ? এই ধূমকেতুতেই ১৯২২ সালে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তিনিই প্রথম উপমহাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জেল জুলুম সহ অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হন ।এটা সেই সময় যখন গান্ধি ও জিন্নাহ সাহেবরা পর্যন্ত স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারণ করতে ভয়ে কাঁপতেন । — সে সময় মহা মহা 'ইউরোপীয় মাদকাসক্ত চাকরীজীবী' কবিদের কোথায় দেখা গেছে ? ৬. রবীন্দ্রনাথের নাম মাথায় রেখেই বলবো নজরুল উপমহাদেশের সঙ্গীতের সেরা প্রতিভা । তিনি আধুনিক বাংলা গানের জনক । পৃথিবীতে ছিল না , এরকম ১৮টি নতুন রাগের তিনি স্রষ্টা । তাও মাত্র ১০ বছরে। আলাউদ্দিন খান , বেটোফেন কিংবা রবিশংকর মতো মহৎ সঙ্গীতজ্ঞরা যা পুরো জীবন ব্যয় করে করেছেন । অথবা করতে পারেননি । অন্যদের গান যেখানে সাদা কালো টেলিভিশন নজরুলের গান সেখানে রঙিন টেলিভিশন । বিষয় বৈচিত্র্যে , উপমা , উৎপ্রেক্ষা , চিত্রকল্প , কাব্যিকতাসহ যা বহুমাত্রিক । সংখ্যার কথা বাদ দিলাম । — এইখানে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্যদের কী কাজ ? নজরুলের গান নিয়েও আমাদের ভূমিকা রক্ষণাত্মক ।কিন্তু কেন ? ৭. হীরালাল সেন ও নজরুল আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃত । নজরুল বাংলা ভাষার প্রথম কবি যিনি ক্যামেরা ছাড়া চলচ্চিত্রের সকল শাখায় উজ্জ্বল অবদান রেখেছেন ।এক ডজনের বেশী সিনেমার তিনি কারিগর। এখানে প্রেমেন মিত্র , শৈলজা ছাড়া বাকি ভাইয়েরা কই ? ৮. নজরুল অপেরাধর্মী নাটকের পথিকৃত । ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০ টির মতো নাটক তিনি রেখে গেছেন । আমাদের নাট্যাঙ্গনের লোকজন কখনই নজরুল নাটকগুলো ছুঁয়েও দেখেনি । কারণ তাহলে তো আধিপত্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা জুটবে না । ৯. ঔপন্যাসিক নজরুল আজও অনাদৃতই রয়ে গেছে ।জানতে ইচ্ছে করে , মৃত্যুক্ষুধার মতো উপন্যাস বাংলা ভাষায় আদৌ আছে কি ? ১০. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলাভাষার জনসম্পৃক্ততা ও সহজ স্বাভাবিকতার গতি রোধ করে , দেশের ৮০% মানুষের অধিকারকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে , যে কৃত্রিম ভাষা তৈরী করে বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ রোপন করেছিল , তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সফল বিদ্রোহের নায়ক তো নজরুল । নজরুলের ভাষা বিদ্রোহের উপর পর্যাপ্ত আলো ফেললেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। কিন্তু সে কাজগুলো করা হয়নি ।কেন হয়নি ? — এখানে আবেগ নয় তথ্য উপাত্ত দিয়ে কথা বলতে হবে। ১১. নজরুল শুধু কবি নন , সঙ্গীতজ্ঞ নন , আমাদের সাংস্কৃতিক পিতা নন , তিনি আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক। অন্য অনেককে বাদ দিয়ে হয়তো চলা যাবে কিন্তু নজরুলকে বাদ দেয়া অসম্ভব। এই কথা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বুঝে ছিলেন সেই ১৯২৯ সালে , যখন নজরুলের বয়স মাত্র ৩০ । ১২. কারো সাথে তুলনা করা করে কাউকে ছোটো করা উচিৎ না । রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাথার উপরকার তারকাখচিত আকাশ । নজরুল আমার সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা সুখদু:খের রক্তমাংসের মাটির পৃথিবী ।মেহনতি মুক্তিকামী গণমানুষের আত্মা । জসীমউদদীন আমাদের নকশী কাঁথার মাঠ । জীবনানন্দ আমাদের রূপসী বাংলার নিঝুম নিসর্গ । জীবনানন্দ দাশ গভীরতাগ্রাহী একতারা । নজরুল আমাদের প্রাণের হাজার তারের বীনা । এভাবে বিষয়টা 'দেশ' কখনোই দেখবে না । কারণ আধিপত্যবাদের স্বভাবই হলো , বাংলাদেশকে অপমান করার জন্য ক্রমাগত নতুন ফ্রন্ট অপেন করা । |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |