মোদির মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা কতটা কাজে আসবে
যশরাজ শর্মা
|
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর শহর গুজরাটে এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি বলেন, বিরোধীরা মুসলিমদের সঙ্গে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করছে। মোদি বলেছেন, বিরোধী জোট মুসলিমদের ‘ভোট জিহাদ’-এর কথা বলছে। ভারতের জাতীয় নির্বাচনের মাঝামাঝি পর্যায় এখন, যেখানে সাত ধাপের মধ্যে মঙ্গলবার তৃতীয় ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পর্যায়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মোদির বয়ান আরও ধারালো হচ্ছে। এটি বিশ্লেষক, এমনকি সেই মুসলিমদেরও শঙ্কিত করছে, যারা মোদিকে সমর্থন করছিল। তাদের ভয়– মোদির এই বয়ান ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় অক্সিজেন জোগাবে। তবে ভোট জিহাদ বিষয়ে মোদির সাম্প্রতিক বক্তব্য এসেছে ভারতের অন্যতম বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টির নেতা মারিয়া আলমের বক্তৃতার সূত্র ধরে। ভারতের উত্তরপ্রদেশে একটি সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় মারিয়া আলম মুসলিমদের ‘ভোটের জিহাদ’ করতে বলেছেন। কারণ ‘সেটিই একমাত্র জিহাদ’, যার মাধ্যমে তারা মোদিকে ক্ষমতার গদি থেকে নামিয়ে দিতে পারে। বক্তৃতায় তিনি যে ‘জিহাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, সে জন্য নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি তাঁকে আক্রমণ করে। মারিয়া আলম অবশ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আরবি শব্দ ‘জিহাদ’ মানে হলো সংগ্রাম। তিনি এর দ্বারা মুসলিমদের ভোটে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেছেন। নরেন্দ্র মোদি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘ভোট জিহাদ’-এর আহ্বান ‘দেশের গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক’। সমালোচক ও বিরোধী নেতারা অভিযোগ করেন, ভারতের ২০ কোটি মুসলিমকে নিশানা করে প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য দেশের জন্য ক্ষতিকর। মোদি তাঁর বক্তৃতায় মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়েছেন। এমনকি বলেছেন, ‘তাদের বেশি সন্তান হয়’। তিনি বোঝাতে চাইছেন, অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে শেষ পর্যন্ত মুসলিমরা ভারতে হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশেরও কম মুসলিম। এমনকি সরকারি তথ্য বলছে, ভারতে মুসলিমদের প্রজনন হার হিন্দু ও অন্যান্য প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীর তুলনায় দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বস্তুত এসব মন্তব্য রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলক। বিরোধী ও সুশীল সমাজ এর বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করেছে। প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় নাগরিক মোদির এসব ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু পরিহাস হলো, এই বক্তব্য প্রদানের মাত্র দু’দিন পর ২৩ এপ্রিল মোদি আরও এক ধাপ এগিয়ে দাবি করেন, দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ও মুসলিমরা হিন্দুদের সম্পদ চুরির ষড়যন্ত্র করছে। তাঁর ভাষায়, ‘আমি জাতির সামনে সত্য উপস্থাপন করছি যে, কংগ্রেস আপনাদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাদের বিশেষ পছন্দের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতরণের গভীর ষড়যন্ত্র করেছে।’ তিনি এখানে মুসলিমদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এর পর ৩০ এপ্রিল বিজেপি ইনস্টাগ্রামে একটি অ্যানিমেটেড ভিডিও প্রকাশ করে। যেখানে দেখানো হয়েছে, সহিংস ও লোভী মুসলিমরা মধ্যযুগীয় ভারতে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করছে এবং মোদি এসে তাদের উদ্ধার করেছে। ভিডিওটি আবারও মোদির সেই প্রচারণাকেই সামনে আনছে– ভোটে কংগ্রেস নির্বাচিত হলে হিন্দুদের সহায়-সম্পত্তি মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন করবে। যেখানে কংগ্রেসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ১৮ বছর আগে বলেছিলেন, মুসলিমসহ সুবিধাবঞ্চিত ভারতীয় সম্প্রদায়গুলোরই প্রথম ভারতের জাতীয় সম্পদে অগ্রাধিকার থাকা উচিত। বলা বাহুল্য, কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে কোনো সম্প্রদায়ের সম্পদ কেড়ে নিয়ে অন্যদের দেওয়ার কথা উল্লেখ নেই। তা ছাড়া অন্য যেসব ষড়যন্ত্রতত্ত্ব মোদি প্রকাশ্যে বলেছেন, তার মধ্যে ‘লাভ জিহাদ’ অন্যতম। এর মানে, মুসলিম পুরুষরা অন্য ধর্মের নারীদের বিয়ে করবে, যাতে তাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা যায়। আর ‘ল্যান্ড জিহাদ’, মুসলিমরা অনেক জমি ক্রয় করছে বা জমা করছে, যাতে তারা ভারতের ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। নরেন্দ্র মোদির জীবনী লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, মোদি যা করছেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বিজেপি ও মোদি ভারতীয় গণতন্ত্রকে নির্মম শিকারে পরিণত করেছেন। ভারতে মুসলিমদের জন্য সম্ভবত এটি সবচেয়ে খারাপ সময়। এখন মুসলিমরা সব সময় মনে করে, তারা তাদের পরিচয়ের কারণে সমস্যায় পড়ছেন। ইনস্টাগ্রামের অনেক ব্যবহারকারী এটিকে ঘৃণার বয়ান হিসেবে রিপোর্ট করার পর ইনস্টাগ্রাম ৩০ এপ্রিলের ভিডিওটি নামিয়ে নেয়। তবে ভারতের নির্বাচন কমিশন এখনও মোদির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিরোধী দলের নেতারা এর সমালোচনা করেছেন। ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের বিরোধীদলীয় নেতা কংগ্রেসের প্রমোদ তিওয়ারি বলেছেন, এর মাধ্যমে মোদি প্রধানমন্ত্রী পদকে কলঙ্কিত করেছেন। এসব কথা ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে কখনোই আসতে পারে না। এর অর্থ হলো, এই নির্বাচনে ভারতের গণতন্ত্র বিপন্ন এবং এর পরও ভারতের নির্বাচন কমিশন ঘুমাচ্ছে। কংগ্রেস সে জন্য মোদিকে প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা এবং তাঁকে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে বিরত রাখার দাবি জানিয়েছে। নয়াদিল্লিভিত্তিক একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপে স্বাভাবিকের তুলনায় কম ভোট পড়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মোদি মুসলিমবিরোধী বাগাড়ম্বর আওড়াচ্ছেন। যেহেতু কেউ মোদির অর্থনৈতিক উন্নয়নের গল্প গ্রহণ করছে না, সে জন্য তিনি ভোটার মেরূকরণের এ কৌশল নিয়েছেন। মুসলিমবিরোধী ঘৃণা ছড়ানোই এখন বিজেপির প্রচারের মূল সম্পদ। যশরাজ শর্মা: ভারতীয় সাংবাদিক; আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |