ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যাকাণ্ডের কারণ নিয়ে এলাকার মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। ঠিক কী কারণে দীর্ঘদিনের বন্ধু আকতারুজ্জামান শাহীন এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা এখনো অজানা পরিবারসহ তার অনুসারীদের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে উঠে আসা খুনের কারণ নিয়েও তার নির্বাচনী এলাকায় চলছে নানা আলোচনা তদন্ত সামনে আসা স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডি, মাদক চোরাচালান এবং নারী পাচারের বিষয়টি অনেকের কাছেই জানা ছিল। কিন্তু এমপি’র দাপট এমন ছিল যে, কেউ-ই সে সব বিষয় নিয়ে কোনোদিন আলোচনা করেননি। এমপি আনোয়ারুল আজিমের অনুসারীসহ কালীগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে তার ঘটনাবহুল জীবন সম্পর্কে জানা গেছে। যেখানে উঠে আসে শূন্য থেকে কীভাবে তিনি বিশাল প্রভাব- প্রতিপত্তির বলয় তৈরি করেছিলেন। কর্মজীবনের শুরুতে পিতার সঙ্গে কালীগঞ্জ বাজারে মাছের ব্যবসা করতেন আনোয়ারুল আজিম।
৯০ এর দশকের শুরুতে যখন এইচএম এরশাদ ক্ষমতায়, তখন যুক্ত ছিলেন জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে। এ সময় এলাকায় তার আরও একটি পরিচয় ছিল ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে। একই সঙ্গে তিনি ক্রিকেটও খেলতেন। যার কারণে এলাকার তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। এক সময় বড় ভাই আবেদ আলীর মাধ্যমে ঢুকে পড়েন অন্ধকার জগতে।
সে সময়ের বিএনপি নেতা আবেদ আলী এলাকায় মাদক ব্যবসা করতেন। যে ব্যবসায় আনারকে যুক্ত করেন তিনি। মাদকের মাধ্যমে সীমান্তে চোরাচালানের সূত্র খুঁজে পান আনার। শুরু করেন ভারতীয় শাড়ি ও ভিসিবির অবৈধ চালান দেশে আনা। নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে সীমান্তে এ ব্যবসা পরিচালনা করতেন তিনি। এতে স্বল্প সময়ে অনেক টাকা আসতে থাকে তার হাতে। ১৯৯০ সালের দিকে এলাকার পরিতোষ ঠাকুর নামে এক স্বর্ণ চোরাকারবারির সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এরপর থেকে শুরু করেন স্বর্ণ চোরাচালান। ১৯৯৩ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় তখন তিনি পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডে কমিশনার হিসেবে নির্বাচন করেন। ১৯৯৬ সালে যুক্ত হন আওয়ামী লীগে। তাকে সে সময় আওয়ামী লীগে নিয়ে আসেন বর্তমান কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব হোসেন খান। এরপর বিএনপি’র শেষ সময়ে মামলার কারণে ভারতে চলে যান।
সেখানে তার পরিচয় হয় দক্ষিণ বঙ্গের এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে। ওই নেতার সমর্থনে এক সময় পরিতোষ ঠাকুরকে সরিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান নিজের হাতে নিয়ে নেন। এরপর থেকে ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোরসহ সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা দিয়ে যত অবৈধ ব্যবসা হতো তাতে জড়িয়ে যান তিনি। এক সময় দক্ষিণ বঙ্গের ওই প্রভাবশালী নেতার সমর্থনে মহেশপুর জীবননগর, দর্শনা, গেদে, চৌগাছা এলাকা দিয়ে যত মাদক, স্বর্ণ চোরাচালান, নারী পাচার হতো তার সবটাই আনারের লোকজন করতেন। ওই প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে আনারের খুন হওয়ার আগেও লেনদেন ছিল বলে এলাকাবাসী জানান। ২০০৪ সালে পৌরসভায় মেয়র নির্বাচন করে হেরে যান তিনি। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা হলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
২০০৮ সালে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোল ওয়ারেন্ট জারি করে। ওই বছরের শেষে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে কালীগঞ্জে ফিরে আসেন তিনি। ২০১০ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ফের শুরু হয় এমপি আনারের রাজত্ব। আস্তে আস্তে নিজের বলয় তৈরি করতে থাকেন। কোণঠাসা করতে থাকেন যাদের হাত ধরে আওয়ামী রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাদের বিশেষ করে যার হাত ধরে এলাকায় ফিরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেন তৎকালীন এমপি আব্দুল মান্নানকেও আস্তে আস্তে কোণঠাসা করতে শুরু করেন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের টিকেটে এমপি হওয়ার পর থেকে কালীগঞ্জে শুরু হয় আনোয়ারুল আজিমের একচ্ছত্র শাসন। আস্তে আস্তে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে নিজের অনুসারীদের ক্ষমতায়ন করেন। আর পুরনোদের বিভিন্ন মামলা-হামলার মাধ্যমে কোণঠাসা করতে শুরু করেন। কালীগঞ্জে পৌরসভা মেয়র থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন নিজের আত্মীয়দের। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের প্রধান মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত পার্শ্ববর্তী কোটচাঁদপুরের বাসিন্দা আকতারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে এমপি আনারের সম্পর্ক প্রায় ৩০ বছরের। মেজো ভাই এনামুল হক ইমানের মাধ্যমে শাহীনদের পরিবারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বন্ধুত্বের প্রায় ১৫ বছর তারা একসঙ্গে সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক চোরাচালান, নারী পাচার ও হুন্ডি ব্যবসা করতেন বলে জানা গেছে। যদিও এলাকাবাসীর কাছে শাহীন নামটি বেশ অজানা। এমনকি শাহীনের এলাকার মানুষও ঠিকমতো তাকে চেনে না।
মূলত অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা নিয়ে এমপি আনারের সঙ্গে আকতারুজ্জামান শাহীনের সক্ষতা বাড়ে। দুইজন মিলে পরিচালনা করতেন স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডিসহ নানা অবৈধ ব্যবসা। এয়ারপোর্ট থেকে স্বর্ণ গ্রহণ করে ভারতের সীমান্ত পার করে দেয়া পর্যন্ত দায়িত্ব ছিল এমপি’র। বাকি কাজ শাহীন করতো। কিন্তু বছর দুয়েক আগে প্রায় ২০০ কোটি টাকার একটি চালান নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় বলে আলোচনা রয়েছে। যেটি ভালোভাবে নিতে পারেনি শাহীন। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সমাধান করতে চাচ্ছিলো শাহীন কিন্তু দুইজনের মধ্যে এটির সমাধান হয়নি।
এলাকায় এমপি’র ঘনিষ্ঠ সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তে স্বর্ণ, মাদক চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসায় এমপি আনোয়ারুল আজিম মাঝের সারির ক্ষমতাধর। কারণ তার এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আছে দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা। ১৯৯৬ সালের দিকে ভারতে থাকা অবস্থায় তাদের মধ্যে বেশ সখ্যতা তৈরি হয়। মারা যাওয়ার আগেও ওই নেতার সঙ্গে আনারের দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও আনারের পার্শ্ববর্তী জেলারও একজন এমপি এসব ব্যবসায় আনারকে সহায়তা করে থাকেন বলে আলোচনা আছে। তাকেই কেন্দ্রে দলের মধ্যে আনারের শেল্টারদাতা বলা হয়। আর সীমান্তে শাহীন ও আনারের ব্যবসার দেখভাল করেন নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। এলাকাবাসী জানায়, কেশবপুরের সাবেক এক এমপিও এসবে যুক্ত। যার সঙ্গে এমপি আনারের অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ ছিল দীর্ঘদিনের। এ ছাড়াও বেশ কয়েক বছর আগে হত্যার শিকার হওয়া সীমান্তে আনারের আরেক ব্যবসায়িক পার্টনার দর্শনার সাইফুল ইসলাম ছিলেন সীমান্ত কেন্দ্রিক দেখভালের দায়িত্বে। যে হত্যা মামলায় এমপি আনারের নাম ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সে মামলা থেকে অব্যাহতি নেন। বর্তমানে এমপি আনারের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন- সাবেক কাউন্সিলর মাসুদুর রহমান মন্টু, সাবেক বিএনপি নেতা ও বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা মোসা মোল্লা ও আব্দুল মালেক। এ ছাড়াও মাদক ব্যবসায় এমপি’র সহযোগী রুবেল নামে একজন। যার বিরুদ্ধে মাদকের ৮টি মামলাও রয়েছে।
উপজেলার কুলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আনন্দ মোহন ঘোষকে মেরে লাশ গুম করে ফেলারও অভিযোগ ছিল নিহত এমপি’র বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও এলাকায় বিরোধী মতের বলে তিনজনকে হত্যার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। যদিও এসব মামলায় তার নাম নেই। কালীগঞ্জ থানার ওসি আবু আজিফ জানান, এমপি’র বিরুদ্ধে আগে ২৬টা মামলা ছিল। সবগুলো খারিজ হয়ে গেছে। এ সময় ইন্টারপোলের ওয়ারেন্ট ছিল বলেও জানান ওসি। কালীগঞ্জের মেয়র আশরাফুল ইসলাম বলেন, এমপি’র বিরুদ্ধে যেসব ব্যবসার অভিযোগ আনা হয়েছে এর সবই মিথ্যা। তার এমন কোনো ব্যবসা ছিল না। এদিকে এমপি’র মেয়ে মোস্তারিন ফেরদৌস ডোরিন বলেন, আমার বাবার বিরুদ্ধে যেসব ব্যবসার অভিযোগ আনা হচ্ছে এর সবই মিথ্যা। নিহত মানুষের ওপর এ ধরনের মন্তব্য করা ঠিক না। তার বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকতো তাহলে এতদিন কেন সামনে আসেনি। কালীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব হোসেন খান বলেন, এমপি’র বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যবসার কোনো খবর আমাদের কাছে ছিল না। এটা সঠিক নয় বলে মনে করি।