যে কবিতার জন্য এরশাদের হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল মোহাম্মদ রফিককে
‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’- কবিতায় লিখেছিলেন মোহাম্মদ রফিক।
নতুন সময় ডেস্ক
|
তখন ১৯৮৭ সাল, সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে; তখন একটি কবিতা লিখেছিলেন কবি মোহাম্মদ রফিক। সেই কবিতার জন্য তাকে সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়েছিল, হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। আবার সেই কবিতা সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন চাঙা করতে জুগিয়েছিল রসদ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসম সাহসে দাঁড়ানো সেই কবি মোহাম্মদ রফিক রোববার ৮০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। একুশে পদকজয়ী এই কবি দীর্ঘদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতার পর ২০০৮ সালে অবসর নিয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে গত শতকের ষাটের দশকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তখনই মোহাম্মদ রফিকের কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তখন সামরিক শাসক আইয়ুব খানবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন রফিক। এই কারণে সামরিক আদালতে তাকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেনর রফিক, স্বাধীন বাংলা বেতারেও তিনি কাজ করেন। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন রফিক। তার কাব্য চর্চাও চলে। গত শতকের ৮০ এর দশকে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, রাজনীতি সচেতন রফিক তাতেও সক্রিয় হন। এরশাদের নামে তখন নিয়মিত কবিতা ছাপা হত সরকারি পত্রিকাগুলোতে, প্রথম পাতায়। সেগুলো আসলে এরশাদের নিজের লেখা কি না, তা নিয়ে অনেক কবিরই ছিল সন্দেহ। তখন এরশাদকে নিয়ে কবি মোহাম্মদ রফিক লিখেছিলেন ‘খোলা কবিতা’ নামে আলোড়ন তোলা কবিতাটি, যার কয়েকটি পঙক্তি ছিল এমন- ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’। চার বছর আগে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই কবিতা তখন কেউ ছাপাতে সাহস পায়নি। গোপনে তা ছাপানো হয় এক ছাপাখানায়। নিউজপ্রিন্টে এক ফর্মায় ছাপানো ১৬ পৃষ্ঠার সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্র-ছাত্রীরা। এভাবে হাতে হাতে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। কীভাবে রচিত হয়েছিল সেই কবিতা? মোহাম্মদ রফিক বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “কবিতাটি আমি লিখেছিলাম জুন মাসের এক রাতে, এক বসাতেই। আমার মনে একটা প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, মনে হচ্ছিল একজন ভুঁইফোড় জেনারেল এসে আমাদের কবিতার অপমান করছে।” কবিতাটির লক্ষ্যবস্তু তাহলে এরশাদই ছিল- এমন প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, “এটা শুধু এরশাদকে নিয়ে লেখা কবিতা নয়। এরশাদের মার্শাল ল জারি আমার কাছে একটা ঘটনা। কিন্তু একজন লোক, যে কোনোদিন লেখালেখির মধ্যে ছিল না, ভূঁইফোড় - সে আজ সামরিক শাসন জারির বদৌলতে কবিখ্যাতি অর্জন করবে, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।” কবিতাটি প্রচার পাওয়ার পর একদিন মোহাম্মদ রফিককে ডেকে নেওয়া হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের দপ্তরে। রফিক বলেছিলেন, “সেখানে তিনজন সেনা কর্মকর্তার মুখোমুখি আমি। তাদের প্রথম প্রশ্ন, এটা কি আপনার লেখা? আমি বললাম হ্যাঁ, আমার লেখা। আমি তাদের বললাম, আমি আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেব, কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দেব না। সেটা হচ্ছে, এটি কে ছেপে দিয়েছে। কারণ আমি তাকে বিপদে ফেলতে চাই না।” তার কিছুদিন পর হুলিয়া জারি হলে মোহাম্মদ রফিককে আত্মগোপন যেতে হয়েছিল। মোহাম্মদ রফিক কোনোভাবেই এরশাদকে কবি বলতে নারাজ। তার ভাষ্যে, “সে তো কবি নয়। বাঙালির সবচেয়ে বড় গর্বের জায়গা হচ্ছে কবিতা। কারণ কবিতা চিরকাল বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু এই কবিতাকে আসলে এরশাদ ধ্বংস করতে চেয়েছে।” এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় তরুণ কবিরা তখন ঢাকায় ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’ আয়োজন করেছিলেন। সেখান থেকে গঠিত হয় জাতীয় কবিতা পরিষদ। শামসুর রাহমান হয়েছিলেন পরিষদের সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মূল সংগঠকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মোহাম্মদ রফিক। মোহাম্মদ রফিক মনে করেন, প্রবল পরাক্রমশালী সেনাশাসক এরশাদকে যে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল, তার পেছনে কবিতা এক বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |