একের পর এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে ব্যর্থতার দায় কার?
|
একের পর এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে ব্যর্থতার দায় কার? যতো দোষ এই প্রতিটি বিস্ফোরণের ঘটনার পর পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন৷ প্রতিবারই একটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। রিপোর্ট দেওয়ার জন্য কমিটিগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়৷ কিন্তু অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদন আসতেই লম্বা সময় পেরিয়ে যায়। আবার প্রতিবেদনে তদন্তের ফলাফল সামনে এলেও দুর্ঘটনার সকল দায় শেষ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি, ভবন মালিক, কারাখানা মালিক বা মসজিদ কর্তৃপক্ষের ওপরেই চাপানো হয়। "মানুষ ভীষণ অসচেতন, তারা ব্যস্ততার অযুহাত দিয়ে গ্যাসের লিকেজ ঠিক করে না, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বদলাতে চাই না। বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখি না। এভাবে আমরা ঝুঁকি তৈরি করছি। কিন্তু এতো ঘটনার পরও কারও টনক নড়ে না।" এমনটাই জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অপারেশন্স বিভাগের পরিচালক তাজুল ইসলাম চৌধুরী। বিস্ফোরণ ও অগ্নি দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন ভবন পরিদর্শনে তিনি জানতে পেরেছেন, ফায়ার সার্ভিস বা সিটি করপোরেশন থেকে অগ্নি নিরাপত্তা মেনে যে নকশা পাস করা হয়, ভবনটি সেই মোতাবেক বানানো হয়নি। অন্তত ৭০ ভাগ ভবনে তিনি এই ব্যত্যয় হতে দেখেছেন। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া বা কাউকে নিয়ম মানতে চাপ দেয়ার কোন এখতিয়ার ফায়ার সার্ভিসের নেই বলে তিনি জানান। আবার যাদের গাফেলতির তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তাদের কারও বিরুদ্ধে তড়িৎ কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। কিন্তু একটি ভবনের নকশা অগ্নি নিরাপত্তা মেনে করা হয়েছে কিনা, আগুন নেভানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে কিনা, সেইসাথে কেমিকেল মজুদ বা কারখানার লাইসেন্স দেয়ার সময় পর্যাপ্ত নজরদারি ছিল কি না সেগুলো নিয়মিত তদারকি করার নিয়ম সরকারি সংস্থাগুলোর। আবার কোন ভবনে অবৈধ বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংযোগ কিভাবে এলো, এই অক্সিজেন কারাখানা নিয়ম মেনে পরিচালিত হচ্ছিল কিনা, কন্টেইনার ডিপোতে এতো ক্যামিকেলের মজুদ কিভাবে হল, সেটা নিয়ে কোন আলোচনা দেখা যায়নি। এসব বিষয় তদারকি করা সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলেও বার বার তাদেরকে দায় এড়াতে দেখা গিয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থার মধ্যে রয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরণ পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদফতর এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া ব্যাংক এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানিও দায়বদ্ধ থাকে। কিন্তু তদন্ত শেষে ভবন বা প্রকল্পের মালিক ছাড়া আর কাউকেই দায়ী করতে দেখা যায়নি। আবার গাফেলতির অভিযোগে দায়ী মালিককে শাস্তির আওতায় আনার নজিরও বিরল। এর কারণ হিসেবে অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এ কে এম শাকিল নেওয়াজ জানান, সংশ্লিষ্ট এই সংস্থাগুলোকে তদন্ত কমিটিতে রাখার কারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, “এখানে যাদের গাফেলতি থাকতে পারে তারাই যদি কমিটিতে থাকেন তাহলে সেখানে নিরপেক্ষ তদন্ত আশা করা যায় না।” এক্ষেত্রে অগ্নি নিরাপত্তা, রসায়ন, বিস্ফোরক, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ দুর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। যারা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। এতে মালিকপক্ষের সমস্যার পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যত্যয়ের জায়গাগুলো উঠে আসবে। সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে সংশোধনে চাপ সৃষ্টি করা যাবে বলে তিনি মনে করেন। শাকিল নেওয়াজ জানান, “আমাদের এখানে মনিটরিংয়ের জায়গায় বড় ঘাটতি রয়েছে। আবার এতো সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও রয়েছে। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি থাকলে দায়িত্বে অবহেলার জায়গাগুলো আর থাকবে না।” সেইসাথে তিনি সচেতনতার ওপরেও জোর দিয়েছেন। প্রথমত গ্যাসের লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং যেখানে গ্যাস জমার আশঙ্কা রয়েছে যেমন রান্নাঘর বা টয়লেটে যেন বিশুদ্ধ বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে। কোন আবদ্ধ জায়গায় গ্যাসের গন্ধ পেলে লাইন ফ্যান জালানোর আগে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা। তিনি আরও বলেন, “রানা প্লাজার ঘটনার পর যখন বিদেশের বায়াররা শর্ত জুড়ে দিল যে গার্মেন্টসের ফায়ার সেফটির না থাকলে তারা পোশাক কিনবে না। তখনই রাতারাতি এসব প্রতিষ্ঠানের চেহারা বদলে গিয়েছে। আমাদেরও সমন্বিতভাবে নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে এক হওয়া দরকার।” সূত্র: বিবিসি |
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |