|
তারেক রহমানের ৩১ দফা: সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অঙ্গীকার
মোঃ সহিদুল ইসলাম সুমন
|
![]() মোঃ সহিদুল ইসলাম সুমন কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো আজ খণ্ড-বিখণ্ড অবস্থায় পতিত হয়েছে । এই পরিস্থিতিতে তারেক রহমান বারবার ঘোষণা করেছেন যে, গত দেড় দশকের রাজনৈতিক নির্যাতন বা অত্যাচারের জবাব হিংসা কিংবা প্রতিশোধের মাধ্যমে দেওয়া হবে না। তিনি বরং জনকল্যাণমুখী ৩১ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করার কৌশল গ্রহণ করেছেন । এই কৌশল একটি গভীর দার্শনিক স্থানান্তরের ইঙ্গিত বহন করে: যেখানে প্রচলিত রাজনীতি হয় প্রতিশোধপরায়ণ, সেখানে তাঁর নেতৃত্ব নৈতিক ও আদর্শিকভাবে উন্নত এক পথে যাত্রা শুরু করেছে, যার লক্ষ্য জনগণের অর্থনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া - ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’ আহ্বানের মাধ্যমে ঘোষিত অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা । জনস্বাস্থ্যের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি সমাজে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, যেখানে মানবিক মর্যাদা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে । সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে গণ্য করার যে নির্দেশনা রয়েছে , তারেক রহমানের এই পদক্ষেপ সেই সাংবিধানিক দায়িত্ব পূরণের প্রতি গভীর অঙ্গীকার। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার বৈপ্লবিক অঙ্গীকার: NHS মডেল ও বিনামূল্যে চিকিৎসা ৩১ দফার সবচেয়ে বৈপ্লবিক এবং সাহসী অঙ্গীকার হলো ২৬তম দফায় ঘোষিত 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' নীতি। এই নীতির মূল ভিত্তি হলো, উন্নত কল্যাণকামী রাষ্ট্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার আলোকে সকলের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা । এটি কেবল একটি সাধারণ প্রতিজ্ঞা নয় বরং দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করার একটি সুস্পষ্ট ঘোষণা। এই নীতির বাস্তবায়নে যুক্তরাজ্যের National Health Service (NHS) বা এ জাতীয় সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (Universal Health Coverage বা UHC)-এর আলোকে সকলের জন্য সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির নিমিত্তে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে । ইউকে'র এনএইচএস মডেলের উল্লেখ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এনএইচএস বিশ্বের অন্যতম সফল সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, যা প্রমাণ করে যে চিকিৎসা সেবা গ্রহণের সময় অর্থ প্রদান ছাড়াই নাগরিকদের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা সম্ভব। তারেক রহমানের এই ভিশন স্থানীয় সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়; এটি সরাসরি বাংলাদেশকে উন্নত কল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলোর কাতারে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার অধিকার নিশ্চিত করার এই প্রতিজ্ঞা জনগণের পকেট থেকে স্বাস্থ্য ব্যয় (Out-of-Pocket Expenditure) কমানোর দিকে সরাসরি পদক্ষেপ নেবে। যখন রাষ্ট্র এই সেবার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল নাগরিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে মুক্তি পায়। এই নীতি মানবিক মর্যাদাকে কেবল ধারণায় সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব কার্যক্রমে পরিণত করবে। অর্থনৈতিক সাহস: ৫% জিডিপি বরাদ্দের অপরিহার্যতা ও এর গভীর অর্থনৈতিক প্রভাব 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' নীতি বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় বাধা হলো অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ঘাটতি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজ (UHC) অর্জনের জন্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের জিডিপি’র অন্তত ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে । অথচ বাংলাদেশে বিগত ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই খাতে জিডিপি’র বরাদ্দ ১ শতাংশের কম । এই ভয়াবহ কম বরাদ্দের ফলস্বরূপ, দেশের নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকেই মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের একটি বিশাল অংশ নির্বাহ করতে হয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস অনুসারে, দেশে স্বাস্থ্যসেবা বাবদ মোট ব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশ নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকে আসে, যা 'আউট অব পকেট' ব্যয় হিসেবে পরিচিত । এই বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয় দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয় এবং মানুষের সঞ্চয় নিঃশেষ করে দেয়। জনাব তারেক রহমানের অঙ্গীকার হলো, জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপি’র ৫ শতাংশের কম হবে না । এটি বর্তমান অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বিপর্যয়কর ব্যয়ের বিরুদ্ধে একটি বিপ্লবী অর্থনৈতিক অবস্থান। এই ৫% বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি কেবল একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয় বরং একটি অপরিহার্য নীতিগত পরিবর্তন যা পারিবারিক দারিদ্র্য নিরসন এবং মানব পুঁজির ওপর বিনিয়োগকে নিশ্চিত করবে। কম সরকারি বিনিয়োগের (১% এর কম) ফলে সেবার মান কম থাকা এবং বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধির যে দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে ৫% বরাদ্দ প্রদানের সাহস দেখিয়ে তারেক রহমান জনকল্যাণকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন এবং সেই দুষ্টচক্র ভাঙার পথ দেখিয়েছেন। এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে, তিনি বুঝতে পেরেছেন যে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। কাঠামোগত সংস্কার: বিতরণ মডেল ও জনবল উন্নয়ন কেবল অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সেবার কার্যকর বিতরণ ব্যবস্থা। তারেক রহমানের নীতিমালায় কাঠামোগত সংস্কারের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। সর্বাগ্রে রয়েছে প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার ওপর মনোযোগ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা (PHC) শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত নারী ও পুরুষ পল্লী স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে । এটি গ্রামীণ পর্যায়ে চিকিৎসা পৌঁছে দিতে এবং বর্তমানে ডাক্তার ও নার্সের ঘাটতি পূরণে (প্রতি দুই হাজার নাগরিকের বিপরীতে মাত্র একজন ডাক্তার এবং পাঁচ হাজার নাগরিকের বিপরীতে একজন নার্স) একটি কার্যকর পদক্ষেপ । পল্লী স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে নারী ও পুরুষের সমান গুরুত্ব প্রদান তাঁর নারী ক্ষমতায়নের বৃহত্তর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সম্পর্কিত । গ্রামাঞ্চলে নারী স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বিদ্যমান সামাজিক বাধা দূর করতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা, শিক্ষা এবং গবেষণা সুবিধা নিশ্চিত করা হবে 9। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় জোর দিলে স্বাস্থ্যখাতে সামগ্রিক ব্যয়ের চাপ কমবে এবং নাগরিকদের গড় আয়ু ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। স্বাস্থ্যসেবা বিতরণে শৃঙ্খলা আনতে, বিএনপি স্বল্পমেয়াদি (১-৩ বছর) পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেনারেল ফিজিশিয়ান (GP) বা পারিবারিক চিকিৎসক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিককে একজন সরকারি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের অধীনে রাষ্ট্রীয় খরচে সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা শুরু করা হবে । GP ব্যবস্থা হলো NHS মডেলের ভিত্তি; এটি কার্যকর রেফারেল নিশ্চিত করে, তৃতীয় স্তরের হাসপাতালের ওপর চাপ কমায় এবং সেবার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে একটি প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা কাঠামো তৈরি করে। এছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচন না হওয়া পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরো সম্প্রসারিত করা হবে। মধ্যমেয়াদি প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তন । স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তন নিশ্চিত করবে যে সরকারি সুবিধাগুলো সরাসরি সুবিধাভোগীদের হাতে পৌঁছায়, যা দুর্নীতির সুযোগ কমাবে এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাভোগীদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। জনাব তারেক রহমানের অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি প্রমাণ হলো ঐতিহ্যবাহী এবং আধুনিক চিকিৎসার সমন্বয় সাধন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আলোচনায় প্রায়শই ইউনানী, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথি ও কবিরাজি চিকিৎসা ব্যবস্থা উপেক্ষিত হয় । বিএনপি এই প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় অধিকতর উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও বৈজ্ঞানিক করার লক্ষ্যে গবেষণা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে । দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর একটি অংশ এখনও এই চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল। এই পদ্ধতির আধুনিকায়ন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাকে আরও কার্যকর এবং সংস্কৃতি-সংবেদনশীল করে তুলবে। এক মানবিক রাষ্ট্রের রূপকার হিসেবে তারেক রহমান জনাব তারেক রহমানের উপস্থাপিত 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' নীতি এবং এর অর্থনৈতিক কাঠামো (৫% জিডিপি বরাদ্দ ও NHS মডেল) কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক রাষ্ট্রের রূপরেখা। তাঁর নেতৃত্ব জনকল্যাণমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কেবল ক্ষমতা দখল করতে চায় না, বরং রাষ্ট্রের পরিচালনার নৈতিক কাঠামোকে স্থায়ীভাবে পরিবর্তন করতে চায়। স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং এই খাতে ৫% জিডিপি বরাদ্দের মতো সাহসী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতার প্রতীক। দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরাচারী শাসন অবসানের পর, বিএনপি যে প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে সরে এসে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার মতো একটি জনমুখী নীতিকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে, তা তারেক রহমানের নেতৃত্বের পরিপক্বতা এবং মানবিক উচ্চতার পরিচায়ক। জনকল্যাণমূলক এই পদক্ষেপগুলো প্রমাণ করে যে তারেক রহমান জনকল্যাণকে রাজনৈতিক প্রতিবাদের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন। এই নীতি কেবল বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য খাতের মেরামতের ঘোষণা নয় এটি তারেক রহমানের অধীনে ভবিষ্যতের একটি ন্যায়ভিত্তিক এবং মানবিক রাষ্ট্রের চূড়ান্ত রূপরেখা, যা তাঁকে কেবল একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, বরং জনকল্যাণমুখী একজন অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। লেখক : সদস্য, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আহবায়ক, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। Email : msislam.sumon@gmail.com
|
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
