পাঠ্যবইয়ে বড় পরিবর্তন আসছে, যা বাদ পড়ছে, যা যুক্ত হচ্ছে
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
বদলে যাচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব পাঠ্যবই। মাধ্যমিকের প্রতি শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত হচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে লেখা, কবিতা অথবা কার্টুন। প্রতিটি বইয়ের পেছনের কভারে থাকছে গ্রাফিতি। এর বাইরে ইতিহাসনির্ভর অনেক বিষয়েও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পাঠ্যবই থেকে বাদ যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ‘অতিরঞ্জিত’ চিত্র। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার কথা জানানো হয়। এ কারণে চলতি বছরের চেয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বাতিল করা নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক স্তরে একেকটি শ্রেণির জন্য ১০টি বিষয় ছিল। পুরোনো শিক্ষাক্রমে বিষয় আরও বেশি। যেমন পুরোনো শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিকে বইয়ের সংখ্যা ২৩ (সব কটি সবার জন্য নয়)। ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ায় আবার ছাপা হচ্ছে আরবি, সংস্কৃত, পালি ভাষা শিক্ষা বই। পাঠ্যপুস্তকে নানা পরিবর্তনের কথা নিশ্চিত করে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘ইতিহাসে যাঁর যাঁর যে স্থান বা ভূমিকা, সেটাই আমরা নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এ জন্য পরিমার্জনের সঙ্গে জড়িত লেখক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।’ বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ইতিহাসনির্ভর বিষয়েও কিছু কাটছাঁট করা হয়েছে। এনসিটিবি সূত্র বলছে, পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত করা হয়েছে। আর বাদ যাচ্ছে বইয়ের শেষ কভারে লেখা শেখ হাসিনার ছবিসংবলিত বাণী। একই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখাও বাদ যাচ্ছে পাঠ্যবই থেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতার অবদান। আর বাদ যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত কবিতাসহ কিছু ‘অতিরঞ্জিত’ ইতিহাস ও তথ্যগত ভুল। এ ছাড়া অনেক বইয়ের ছবিতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এনসিটিবি সূত্র বলছে, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শ্রেণির সব বইয়ের পেছনের পৃষ্ঠায় জুলাই অভ্যত্থানের গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে। যেমন: দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ের গ্রাফিতিতে লেখা আছে, ‘ভালো মানুষ ভালো দেশ, স্বর্গভূমি বাংলাদেশ’। আর উক্তিতে বলা হয়েছে, ‘পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি’। একই শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের গ্রাফিতিতে রয়েছে, ‘পিপলস ইজ পাওয়ার’ ও উক্তিতে বলা হয়েছে, ‘ডু নট টেল এ লাই’। এভাবে প্রতি শ্রেণির বইয়ে নতুন নতুন গ্রাফিতি ও উক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আর একই সঙ্গে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির প্রতিটি বাংলা বইয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে গল্প, লেখা অথবা কার্টুন যুক্ত করা হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ দু-একজনের কথাও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে গত ১৬ জুলাই রংপুরে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে যান তিনি। বছরের শুরুতে সব শিক্ষার্থীর বই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা সরকার ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে নতুন পাঠ্যবই দিচ্ছে। আগামী বছরের জন্য প্রাক্-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর মিলিয়ে ৪০ কোটির বেশি পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের জন্য ৩০ কোটি ৯৫ লাখ ৪১ হাজার ৪৮৬টি ও প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি। এসব বই ছাপানো ও বিতরণে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। তবে বছরের মাত্র এক মাস বাকি থাকলেও এখনো পাঠ্যবই বিতরণের কাজ শুরু এবং দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি এনসিটিবি। ফলে বছরের শুরুতে সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এনসিটিবি সূত্র জানান, এখনো নবম শ্রেণির দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। আর যেসব শ্রেণির দরপত্র আহ্বানসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে, সেগুলোরও বই ছাপার অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। এ জন্য গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পোস্ট ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) সম্পূর্ণ হয়নি। সব মিলিয়ে জানুয়ারিতে সব শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এবার অনেক দেরিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ জন্যই বই ছাপা ও বিতরণে দেরি হচ্ছে। আগের বছরগুলোয় এ সময়ে অন্তত ৪০ শতাংশ বই উপজেলা পর্যায়ে চলে যেত। সব মিলিয়ে অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আগামী মার্চের আগে সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে। এদিকে নির্দিষ্ট কিছু মিল থেকে কাগজ কিনতে বাধ্য করার অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তাঁরা জানান, এনসিটিবির গুটিকয়েক কর্মকর্তা তাঁদের পছন্দের ৪-৫টি কাগজের মিল থেকে কাগজ কিনতে বলছেন। না হলে পিডিআইতে নেগেটিভ প্রতিবেদন দেবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান রিয়াজুল হাসান বলেন, এ ধরনের অভিযোগ কারও বিরুদ্ধে প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |