তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রত্যাশা পূরণে আইসিটির ক্রয়ে দেশীয় কোম্পানীকে প্রাধান্য দিতে হবে
মুজিবর রহমান পান্না
|
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মোট আকার প্রায় ২.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই খাতের সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জনে পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ দেওয়া প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের নানাবিষয়ে কথা বলেছেন সফটওয়্যার খাতের প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সভাপতি এম রাশিদুল হাসান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক নতুন সময়ের ফিচার এডিটর মুজিবর রহমান পান্না। নতুন সময় : আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাই? এম রাশিদুল হাসান: বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত প্রায় ২.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে দেশীয় বাজারের প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যানুযায়ী সফটওয়্যার এবং তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা রপ্তানি করে দেশে ২০২৩ সালে প্রায় ৮৪০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। বেসিসেসর ৪৫০ সদস্য প্রতিষ্ঠান নিজস্ব প্রস্তুতকৃত সফটওয়্যার এবং তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা রপ্তানি করছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ২ লাখের বেশি তরুণের। বেসিসের ২৭শ সদস্যের বেশিরভাগ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানই ক্ষুদ্র ও মাঝারি (ঝগঊ) আকারের উদ্যোক্তা। স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণের সাথে আমাদের এসএমই তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ের উন্নয়ন সরাসরি জড়িত। দেশের সামগ্রিক তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বেসিস। বেশকিছু নাগরিক সেবা অটোমেশনের কারণে অনেক সহজে সেবা পাচ্ছে দেশের মানুষ। এতে উৎপাদনশীলতা যেমন বেড়েছে তেমনি বাড়ছে বাজারের আকার। এগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি সফটওয়্যার দিয়ে অনেকাংশে অটোমেশন সম্ভব হয়েছে, বিদেশ থেকে এসব সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা আমদানি করতে বাংলাদেশকে প্রচুর ডলার ব্যয় করতে হতো। আমরা সরকারি সকল আইসিটি প্রকিউরমেন্টে দেশীয় কোম্পানীগুলোকে যথাযথভাবে প্রাধান্য দিতে সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছি। বেসিস বর্তমানে ফিনটেক, সাইবার সিকিউরিটি, ও হেলথটেকের বিকশমান স্থানীয় বাজার নিয়ে গবেষণা করছে, যার উপর ভিত্তি করে ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির সবগুলো ক্ষেত্রেই দেশের বাজারের চাহিদা কিভাবে নিজেরাই পূরণে কাজি করছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, জাপান, ফ্রান্সসহ আন্তর্জাতিকভাবে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি বাজারের তথ্যপ্রযুক্তি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে সহযোগিতা করছি যাতে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতগুলোকে সংশ্লিষ্ট দেশে বিস্তৃত করতে পারি। আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বাজার সম্প্রসারণে ’আমেরিকা ডেস্ক’ এবং ‘জাপান ডেস্ক’ করেছি। ভবিষ্যতে অস্ট্রেলিয়াতে রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা চলছে। বেশকিছু বিশেষায়িত সফটওয়্যার ও পরিষেবা আমাদের বেসিস সদস্যগণ ভারতেও রপ্তানি করছেন। নতুন সময় : দেশের তথ্যপ্রযুক্তিখাতের নীতিনির্ধারণীতে বেসিসের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা আছে কী? এম রাশিদুল হাসান: তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ গঠনে সংশ্লিষ্ট সকল নীতিমালা তৈরি এবং ই-গভর্নমেন্ট বাস্তবায়নে বেসিসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেসিস ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য তিন বছরের আয়কর অব্যাহতির সুবিধা বহাল রাখা গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানির ক্ষেত্রে ৬% রপ্তানি প্রণোদনা আদায়ের ক্ষেত্রেও বিশেষ বেসিসের ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া, ইস্যুরটেক গাইডলাইন, ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন ব্যবস্থা প্রণয়নে বেসিস অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে। তবে বিগত সরকারের সময়ে, অনেক সরকারি উদ্যোগে বেসিসকে সম্পৃক্ত করা হয়নি, যেমন, ঘধঃরড়হধষ ঝঃৎধঃবমু ভড়ৎ অৎঃরভরপরধষ ওহঃবষষরমবহপব ইধহমষধফবংয এবং ঘধঃরড়হধষ অৎঃরভরপরধ ওহঃবষষরমবহপব চড়ষরপু ২০২৪ (খসড়া) ইত্যাদি প্রণয়নে বেসিসকে অন্তর্ভুক্ত না করা দুঃখজনক। প্রায় ১,৮৪৬ কোটি টাকা বাজেটের আইটি/বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক প্রতিষ্ঠা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও স্থাপনা সম্পর্কিত কোনো বিষয়েই বেসিসকে সম্পৃক্ত করা হয়নি, ফলে জনগণের এই পরিমানের অর্থের সদ্ব্যবহার নিয়ে যেমন প্রশ্ন থেকে যায়, ঠিক একইভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের সেগুলো তেমন কোন কাজে আসেনি । আমি মনে করি সরকারের আমদানি, রপ্তানি, শিল্প নীতিমালা, মূদ্রানীতি নির্ধারণে আমাদের সরকারীভাবে আরও সম্পৃক্ত করা উচিৎ। অন্যথায়, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমরা অনেকগুলো জায়গায় পিছিয়ে পড়ব। নতুন সময় : সম্ভাবনায় সফটওয়্যার ও আইটি সেবা খাতের উন্নয়নে করণীয় কী? এম রাশিদুল হাসান: দেশীয় অর্থনীতির বিকাশের সাথে সাথে সফটওয়্যার ও আইটি সেবার বাজারও ক্রমবর্ধমান। বর্তমানে বাংলাদেশি সফটওয়্যার ও আইটি সেবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে, যার ফলে জিডিপিতে এই খাতের অবদানকে ১.২৮%-এ উন্নীত করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই কোডিংয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করানো প্রয়োজন। বেসিস দীর্ঘদিন ধরে ইউজিসিকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে যাতে শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম আপডেট করার জন্য। এছাড়া, তরুণদের মধ্যে স্টার্টআপ সংস্কৃতির প্রসারে প্রয়োজনীয় তহবিল ও মূলধন প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। নতুন সময় : তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক মানের মানব সম্পদ তৈরিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী? এম রাশিদুল হাসান: বিশ্বের বড় বড় টেক জায়ান্ট-এ কাজ করছে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা। বাংলাদেশ, নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-এ টানা ৩ বারসহ মোট ৪ বারের চ্যাম্পিয়ন। তবে আমাদের বেশকিছু গ্লোবাল ট্যালেন্ট থাকলেও উচ্চতর দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। দেশের ২০-৪০ বয়সী জনগোষ্ঠির সংখ্যা বাংলাদেশের ৬ কোটি ৪৩ লাখ। এদের মধ্যে আইটি প্রফেশনাল মাত্র ২ লাখ। প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার আইসিটি গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। তবে আমাদের বড় সমস্যা ব্রেইন ড্রেইন। দক্ষ কর্মীরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, তাদের আমরা সুযোগ সুবিধা দিতে পারছি না। এক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটিগুলোকে ইন্ডাস্ট্রির সাথে কোলাবোরেশন করে তাদের গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকুরির ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন সময়: তথ্যপ্রযুক্তিখাতের প্রত্যাশা পূরণে বাধাগুলো এবং অন্তবর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা জানতে চাই। এম রাশিদুল হাসান: অন্তবর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রথম দাবি সরকারি আইসিটির সকল ক্রয়ে দেশীয় কোম্পানীগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটুআই এর মত সরকারি এজেন্সিকে প্রাইভেট সেক্টরের সাথে কোন প্রকারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেয়া যাবে না। এজন্য অতিদ্রুত এটুআই সম্পর্কিত আইন পুরোপুরি সংশোধন করা প্রয়োজন। সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি পেতে ক্যাশলেস ট্রাঞ্জেকশনের যেই শর্ত দেয়া হয়েছে তা শিথিল করতে হবে । আইসিটি রপ্তানীর ক্ষেত্রে নগদ প্রণোদনার পরিমান বাড়িয়ে ১০% করা লাগবে । বিগত সরকারের সময়ে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের মতো অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিষেবা শিল্পের ৩,৩০২ কোটি টাকার মতো ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে এবং এর দরূণ ঘটে যাওয়া দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি লাঘবে দ্রুততার সাথে একটি ২% সুদের ৫০০ কোটি টাকার ঘূর্ণায়মান ঋণ তহবিল গঠন করার আহবান জানাচ্ছি বাংলাদেশ ব্যাংককে । নতুন সময় : ই-কমার্স খাতকে এগিয়ে নিতে কী কী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এম রাশিদুল হাসান: বৈষম্যহীন তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ খাত হতে পারে ই-কমার্স। এ খাতের মাধ্যমে মেধাবী তরুণদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব। অনলাইনে, এফ-কমার্স ও ই-কমার্সের মাধ্যমে সারা দেশের ভোক্তাদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন, এমনকি গ্রামে অবস্থানরত একজন তরুণ। দেশের ডিজিটাল কমার্সের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে বেসিসকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বেসিস ডিবিআইডি (ডিজিটাল বিজনেস আইডি) ডেস্ক স্থাপন ও পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে সম্প্রতি। এই প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য বাংলাদেশের বিক্ষিপ্ত ব্যবসাগুলোকে একত্রিত করে ব্যবসার তাৎক্ষণিক নিবন্ধন, বৈধতা এবং বাচাইকরণ সম্পন্ন করা। ই- কমার্সকে এগিয়ে নিতে দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্য আরও কমাতে হবে এবং নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করতে হবে। ক্যাশলেস পেমেন্টের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট এবং মার্চেন্টকে সরকারের পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে ব্যবসায়ী-ক্রেতা উভয়ই ক্যাশলেস পেমেন্ট সিস্টেমে অভ্যস্থ হতে পারে, এতে করে সরকারের প্রত্যাশানুযায়ী রাজস্ব ফাঁকির পরিমানও অনেকাংশে কমে আসবে।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |