ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করায় ছাত্র সংগঠনগুলোর আচরণে কোনো পরিবর্তন আসবে?
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Thursday, 24 October, 2024, 9:36 PM
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে অন্তর্বর্তী সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণার পর ছাত্র রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না সেটি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের বড় ভূমিকা থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এর ছাত্র সংগঠনের দলীয় লেজুড়বৃত্তি চর্চা শুরু হয়। এটি আরেও প্রকট হয়ে ওঠে গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় থাকাবস্থায়।
প্রকৃত অর্থে ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সোচ্চার না হয়ে এ সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন, ধর্ষণের মতো ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, যেসব কারণে সরকার ৭৫ বছরের প্রাচীন এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করলো এর ফলে পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির সেসব জায়গায় কোনো পরিবর্তন আসবে কি?
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো অঙ্গ সংগঠন বা ছাত্র সংগঠন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকবে না এ বিষয়টি এখন নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে। আর ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়েই যদি এ বিষয়টি করা যায়, তবে ভবিষ্যতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনগুলোর কাছে একটা বার্তা পৌঁছাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে ভবিষ্যতে ছাত্র রাজনীতির সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে কি না সেটি এখনই বলার সময় হয়নি। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার বিষয়টি এতে জড়িত।
একই সঙ্গে নির্বাহী প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ না করে জনসমর্থনের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ হলে সেটি বেশি কার্যকর হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
'ছাত্র সংগঠনের দলীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে'
বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠন, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ ওঠে। হত্যা মামলায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের মৃত্যুদণ্ডের নজিরও রয়েছে।
২০১৯ সালে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে দলটির তৎকালীন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ঘিরে আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে মাঠে বিতর্কিত ভূমিকায় দেখা গেছে ছাত্রলীগকে। গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলি চালানোর মতো ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এ সংগঠনটির কার্যক্রম।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে বিশ্লেষণমূলক একাধিক বই লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি মনে করছেন, ছাত্র রাজনীতির নামে এতোদিন যা হয়েছে তা রাজনৈতিক দলগুলোর ক্যাম্পাসভিত্তিক অঙ্গ সংগঠন। ছাত্র সংগঠনের প্রকৃত চরিত্র থেকে সরে এসে তারা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে।
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'অর্থাৎ ছাত্রলীগ মানে আওয়ামী লীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ছাত্রদল মানে হচ্ছে বিএনপির বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। আমার মনে হয় এই জিনিসটা একেবারেই বন্ধ হওয়া উচিত।' ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষা বা শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে কাজ করাই ছাত্র সংগঠনের কাজ হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'নীতিগতভাবে ছাত্র সংগঠনের দলীয় রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একেবারেই বন্ধ হওয়া উচিত। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে যদি এ জিনিসটাকে সামনে নিয়ে আসা যায় আমি মনে করি যে সামনের দিনে ছাত্রদল বা শিবির এদের কার্যক্রমেও নিষেধাজ্ঞা আসা উচিত।'
তার মতে, ছাত্ররা যারা রাজনীতি করতে আগ্রহী তারা সরাসরি রাজনৈতিক দলে যোগদান করতে পারে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দলীয় রাজনীতির জায়গা নয়।
মহিউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, 'একটা নীতিগত সিদ্ধান্তে আসা উচিত যে, রাজনৈতিক দলের কোনো ছাত্র সংগঠন থাকবে না। যারা ওই দলের সমর্থক তারা সরাসরি ওই দল করবে আলাদা করে ছাত্র সংগঠন থাকবে না, এটাই নীতিগত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।'
রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়টি কখনো উত্থাপন করবে না। কারণ ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের এ সময়ে যে সংস্কার চলছে তাতে এ বিষয়টি জোরালোভাবে আসা উচিত বলে মনে করছেন তিনি।
তবে এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার ফলে ‘ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে’ পরিবর্তন আসবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা বলা মুশকিল। কারণ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে যে কারণে এগুলো একেবারে কতগুলো ইমমিডিয়েট কারণে আমরা দেখলাম। গত কয়েক বছরে তারা যে সমস্ত কাণ্ডকারখানা করেছে সেটার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এটা করেছে। কিন্তু এ কাজগুলো অন্যরাও করে। সুতরাং ছাত্রলীগকে দিয়ে অন্যদের শেখানো না বরং আমি মনে করি ছাত্রলীগকে ধরেই এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্তে আসা উচিত।
এর আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন অগাস্টে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবায়দা নাসরীন অবশ্য নিষিদ্ধকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নাসরীন বলেন, যে নির্বাহী প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল, সেভাবে সংগঠন নিষিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু সেটা যদি জনগণের রায় নিয়ে করা হতো, তাহলে আরও শক্তিশালী বার্তা যেত। যে প্রক্রিয়ায় করা হয় সেটা কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেটাকে গণতন্ত্রমুখী করার ক্ষেত্রে বার্তা যায় না।
'নির্বাহী ক্ষমতার আদেশে যখন কিছু বন্ধ করা হয় এবং সেটা যদি জনগণের সমর্থন ছাড়া করা হয় তখন কিন্তু নতুন কোনো সরকার আসলে সেটা বিশেষ ক্ষমতা আইনে আবার বাতিলও হতে পারে। যেটা আমরা জামায়াতের ক্ষেত্রে দেখেছি।'
জোবায়দা নাসরীন বলছেন, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধকরণের এ সিদ্ধান্তে 'একটা গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ যাবে, যে ম্যালপ্রাকটিসগুলো এতোদিন ছাত্র সংগঠনগুলো করেছে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সংগঠনগুলো করেছে তাদের কাছে বড় ধরনের মেসেজ যে এটা করা যাবে না। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় সরকার এটা করেছে তাতে এটা টেকসই প্রক্রিয়া হিসেবে কার্যকর থাকছে না।'
একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসলে তা আরেও কার্যকরী হতো জানিয়ে নাসরীন বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা দেখেছি জামায়াত নিষিদ্ধ হয়েছে। সেটাও নির্বাহী আদেশে হয়েছে। তো আমার কাছে মনে হয় যে, এটা যদি জনগণের ম্যান্ডেট হয়ে আসতো, নির্বাহী আদেশে না হয়ে- সংসদ চালু হওয়ার পরে গণতান্ত্রিক পরিবেশে একটা ডেমোক্রেটিক প্রক্রিয়ায় হলে এটা সাসটেইন করার গুরুত্ব পেতো।
আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান মনে করছেন, বয়সের দিক থেকে ছাত্রলীগের মতো বড় একটি সংগঠনের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা আসায় অন্য সংগঠনগুলোর কাছে একটি বার্তা যাবে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির অতীত সংস্কৃতি থেকে সংগঠনগুলো বের হতে পারবে কি না এটি এখনো বিবেচ্য বিষয়।
রওনক খান বলেন, 'এটি নির্ভর করবে নির্বাচন পরবর্তীতে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করবে তাদের চাওয়া-পাওয়ার উপর। তারা আসলে কতটুকু চায় নাকি তারাও প্রতিহিংসার রাজনীতিতে আবার চলে যায়।'
'ওই সরকার কী আগে দেশ গঠন করবে নাকি রাজনীতির পুনরাবৃত্তি করবে তার উপরে অনেকটুকুই নির্ভর করবে।'
যে কারণে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ
বুধবার (২৩ অক্টোবর) সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে 'নিষিদ্ধ সত্তা' হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করিয়া বিগত ১৫ বৎসরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সকল গণমাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হইয়াছে।
'যেহেতু ১৫ জুলাই ২০২৪ তারিখ হইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উম্মক্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করিয়া শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করিয়াছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করিয়াছে।'
এ প্রজ্ঞাপনে সরকার জানিয়েছে, পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সাথে জড়িত রয়েছে। সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। এসব কারণে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।