সাকিব-তামিম শত্রুতা! বাংলাদেশ ক্রিকেটের অশনি সংকেত!
মাহবুব নাহিদ
|
যারা বলেন, আবেগ দিয়ে চলে না! তাদেরকে বলি ভাই, আবেগ ছাড়া চলেই না। আবেগ না থাকলে এইসব খেলা রান উইকেট জেতা-হারা সবকিছুই নস্যি মনে হতো। আবেগ না থাকলে কোথাকার তামিম সাকিব কী খেললো না কী করলো তা নিয়ে আমাদের কিছুই আসতো যেতো না! মাশরাফি বিন মুর্তজা এতগুলো অপারেশন করা পা নিয়েও খেলে গেছেন কেন জানেন? এটা ভালোবাসা, ক্রিকেটের প্রতি, দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি! এই আবেগটা না থাকলে কিছুই থাকতো না। মনে পড়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের সঙ্গে অমনভাবে হারার পরে মুশফিককে জড়িয়ে ধরে সাকিবের কান্নার কথা? সাকিবের যদি আবেগ নাই থাকে, সে যদি একদম লৌহ মানব হয়ে থাকে তবে সেদিন তিনি কেন কেঁদেছিলেন? কেঁদেছিলেন ওই আবেগের জন্যই, লালনের ওই গানে বলেছিল, পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না, তেমনি করেই বলতে হয়, আবেগ ছাড়া কিছুই চলে না জনমে জনমে রেখেছি অন্তরে, মন তারে মনে পড়ে অবেলায়, অসহায় মন করে হায় হায়, তার বিহনে প্রাণও জ্বলে যায়। কী হতে কী ভাবি, লুকিয়ে ডুকরে কাঁদি। মোরা এক সময় প্রাণের সখা ছিলাম, গান গাইতাম, গল্পের ফাঁদে আটকে যেতো জীবন। মনে হতো, বন্ধু তুই পাশে থাকলে পাড়ি দেবো সাগর নদী পাহাড় সবকিছুই। চলতে পথে কতো কথা হয় কতো ঘটনা ঘটে যায়, কোথায় কোন অকারণে বন্ধু হয়ে যায় শত্রু। চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, বুক ফেটে যায় কষ্টে, মুখ ফোটে না। দু’জনের দ্বন্দ্বে কতো যে কথা ছড়ায়, চুপ থাকে দু’জনে, কারণে আর অকারণে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন যদি হয় একজন কথা কয়! তাহলেই তো হয়ে যায়, কিন্তু হায়, প্রকৃতিও অসহায়, তামিম হেঁটে যায়, সাকিবের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই হয়তো লাগে অসহায়, কিন্তু মুখ ফুটে কথা না বলার যন্ত্রণায় দু’জনেই কেঁদে যায়, খুব নীরবে, দুজনেই হারিয়ে যায় গহীনে, ঘোর লাগা অন্ধকারে! এই মুহূর্তে এই গোষ্ঠী অর্থাৎ সাকিব ভক্ত+তামিম হেটার এবং তার সঙ্গে তামিম ভক্ত+সাকিব হেটার এই গোষ্ঠী দুইটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অশনি সংকেত! সকল তামিম ভক্ত কিংবা সকল সাকিব ভক্ত এই তালিকায় নেই কিন্তু! বাংলাদেশ ক্রিকেটের আত্মা হৃদয় কলিজা জান প্রাণ যাই বলা হোক সেটা সাকিব আল হাসান, নিঃসন্দেহে! কিন্তু তামিম ইকবালকে আপনি কোনোভাবেই বাদ দিতে পারবেন না। তার অবদানও বাংলাদেশ ক্রিকেটে কম না। বাংলাদেশ বারবার তার রিপ্লেসমেন্ট খুঁজতে চেয়েছে কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে তার পার্টনারই খুঁজে পায়নি। তবে হ্যাঁ, তামিমের ডটবল খেলার প্রবণতা তার ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের তুলনায় বেড়েছে। আর সাকিব আল হাসানের ব্যক্তিগত আচরণ বা কর্মকাণ্ডে কিছু সমস্যা আছে। সেটা নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই হওয়া উচিত। কিন্তু সমালোচনা করতে গিয়ে সোশ্যাল এই দুইজনকে নিয়ে যেভাবে নোংরামো করা হচ্ছে সেটা দেশের জন্য ভয়ংকর। সাকিব আল হাসান বিপিএল কেন শুধু! তিনি তো দেশের ইতিহাসেরই সেরা খেলোয়াড়, বারবার বিপিএলের সেরা খেলোয়াড় পুরস্কার পেয়েছেন, তাই বলে কি তামিমের এবারের চ্যাম্পিয়ন হওয়া, টপ রান স্কোরার হওয়া বা সেরা খেলোয়াড় হওয়া উদ্যাপন করা যাবে না? এবার যিনি পেয়েছেন তাকে বা তার ভক্তকে উদ্যাপন করতে দেন না ভাই, কী সমস্যা? তামিম ইকবাল যখন মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহকে ডেকে নিলেন কিংবা ছোটদের দিয়ে ট্রফি গ্রহণ করালেন বিষয়টা সবাই আবেগের সঙ্গে নিয়েছে, ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। তামিম হয়তো জাতীয় দলে খেলবেন না বা খেলতে পারবেন না। কিন্তু হাথুুরুসিংহে নামক একটা ভিনদেশি মানুষ এসে আমাদের একজন ন্যাশনাল হিরোকে আমাদের কাছে খলনায়ক বানালেন আর আমরা সেটা বসে বসে গিললাম। মনে পড়ে সেই ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামার কথা? ওইদিন তামিম ইকবালের ফিটনেস টেস্ট করে নামানো উচিত ছিল না? আনফিট খেলোয়াড় কীভাবে নামলো? নেমেছিল আবেগ দিয়ে। তামিম ইকবালকে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ দেয়া নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সাকিব আল হাসান জড়িত আছেন কিনা এটা নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। তদন্ত কমিটি পর্যন্ত হয়েছে। হয়তো তদন্ত কমিটি সাকিব আল হাসানের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়নি। কিন্তু একটাবার ভাবুন তো, সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপের আগে টি স্পোর্টসকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, ওটা দেখে কার মনে হবে না যে তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি বললেন, এটা তো এরকম না যে আমার ব্যাট আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে খেলবো! মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি বললেন, তিনি এই দলে এবাদতকে মিস করবেন, এতটা ঔদ্ধত্য দেখানো কি ঠিক হয়েছে? যেখানে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তামিমবিহীন একজন ওপেনার খুঁজে পাননি যে কিনা তামিমের সঙ্গ দিতে পারে! সাকিব আল হাসান আবার বললেন, দলের প্রয়োজনে যেখানে ইচ্ছা সেখানে খেলতে হবে, তিনি রোহিত শর্মার উদাহরণ দিলেন। কিন্তু রোহিত শর্মা নিজেই আবার বললেন, আমি পাগল হয়েছি নাকি যে সাত নম্বরে খেলবো? আবার সাকিব নিজেই বললেন, একজনকে হুট করে এক জায়গায় খেলতে বলা নাকি পাগলামি! তিনি বললেন, ইনজুরি নিয়ে খেলা নাকি দেশের সঙ্গে চিটিং করার শামিল। অথচ আমরা জানলাম যে তিনি নিজেই নাকি সারা বিশ্বকাপ চোখের সমস্যা নিয়ে খেলেছেন। সাকিব নিজেই নিজের বক্তব্যে ঠিক থাকতে পারেননি, অন্যরা কী করবে! দুঃখ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে তাদের, যারা কিনা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে যারা ভালোবাসি তাদের। আমরা কখনো চাই না যে সাকিববিহীন বাংলাদেশ দল, কিংবা তামিম ছাড়া বাংলাদেশ দল। আমরা মনে করি, তাদের দুইজনেরই অবদান রয়েছে। সাকিবের যেমন শত শত অবদান আছে তেমনি তামিমেরও কম নেই। জহির খানকে দুই কদম সামনে এসে মারা ছক্কাটা আমাদের সাহস জোগায়, আমাদের শক্তি দেয় কিংবা সাকিব আল হাসানের ওই স্যালুট আমাদের হৃদয়ে শিহরণ জাগায়। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডব বলা হয় মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহকে। যদিও সাকিব এই পঞ্চপাণ্ডব মানতে নারাজ, তবুও দেশ তো মানে। এই পাঁচজন ছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কল্পনা করে দেখেন! একদম ধূসর তামাটে দেখাবে আমাদের ক্রিকেটকে, মনে হবে কিছুই নেই যেন! দুঃখের বিষয় হচ্ছে এদের সকলের বিদায় বেলায় এসে গেছি আমরা। মাশরাফি তো বিদায় নিয়েছেন, তামিমও ধরা যায় বিদায়, বাকিদের অবস্থাও যাবো যাবো করছে। একটা কথা মনে করা খুব দরকার, সাঙ্গাকারা, জয়াবর্ধনেরা চলে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট কিন্তু একদম মুখ থুবড়ে পড়েছিল, সেখান থেকে তারা এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকা একটা প্রজন্ম হারানোর পর থমকে গেছে, থমকে গিয়েছিল টিম অস্ট্রেলিয়াও, কিন্তু তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাদের হাতে রসদ ছিল বলে। আমাদের বাংলাদেশ ক্রিকেটের যা অবস্থা, নতুন খেলোয়াড় আসার এবং পারফর্ম করার যে হাল তাতে পঞ্চপাণ্ডবদের বিদায় সম্পন্ন হলে যে অবস্থান বাংলাদেশ ক্রিকেটের আছে তাও থাকবে না বলে আমার বিশ্বাস। তাই এই মহারথীদের বিদায় জানানোর আগে সবচেয়ে যেটা বেশি দরকার সেটা হচ্ছে যোগ্য সম্মানটুকু দেয়া। সাকিব তামিমের বন্ধুত্ব সতেরো বছরের প্রায়, কিন্তু অল্পদিনের শত্রুতা হয়ে গেছে বন্ধুত্বের চেয়েও শক্তিশালী! বন্ধু তো তাকেই বলে, যে একটি লাইন এক বন্ধু বললে পরের লাইন অন্য বন্ধু বলতে পারে। সব সম্পর্ক তো কাগজে লেখা থাকে না, কিছু সম্পর্ক হৃদয়ের মণিকোঠায় লেখা থাকে। মানুষ নিশ্চয়ই তার বন্ধুর ধর্ম দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। বলছিলাম বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান এবং তার প্রিয় বন্ধু তামিম ইকবালকে নিয়ে। বন্ধুত্ব এখন ভেঙে গেছে একদম, দেখা হলেও এখন আর কথা হয় না। সাকিব তামিম হয়তো এখন মনে মনে বলেন ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি?’ উত্তরে হয়তো আরেকজন বলবেন, ‘মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম।’ কাগজে কলমে লেখা সম্পর্কই যখন ভেঙে যায় এ দুনিয়ায়, মনের লেখা সম্পর্কের আর কী দাম থাকে? কিন্তু কোথাও না কোথাও কখনো না কখনো মনে হয়, মনে ডাক দেয়। সেদিন সাকিবের পাশে বসা ইমরুল কায়েসের সঙ্গে হাত মেলালেন তামিম। সাকিবের দিকে ফিরেও তাকাননি। তামিম চলে যাওয়ার পর তাকিয়েছেন সাকিব আল হাসান। তিনি তো এখন অনেক বড় মানুষ, তিনি এখন বড় নেতা! কিন্তু কোথাও যেন মনে হলো সাকিব বড্ড একা একটা মানুষ, অসহায় এক চরিত্র যেন তিনি! তার সেই ফিরে তাকানো তো অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়! ইস্, একটাবার যদি তামিম পিছন থেকে এসে সাকিবকে জড়িয়ে ধরতেন তাহলে হয়তো সবকিছু নিমিষেই ঠিক হয়ে যেতো! এটা হতে পারতো সাকিবের ক্ষেত্রেও। এই যে এগিয়ে গিয়ে নত হওয়া, এটাকেই আমরা ভয় পাই, এটার কারণেই আমরা পিছিয়ে যাই। কেউ একজন এগিয়ে আসলেই হয়তো সব দূর হয়ে যেতো! সেটা কেউ করেননি। আশেপাশের মানুষগুলোও না! পারিপার্শ্বিক মানুষগুলো হয়তো আরও বিষিয়ে তুলেছেন তাদের। আর তাদের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা রেখেছে তাদের তথাকথিত ভক্তরা। একে অন্যের পিছনে লাগতে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই বড় দুই তারকাকে সবাই বানিয়েছে গলির মোড়ের খেলোয়াড়। এরা ক্রিকেটের শত্রু, দেশের শত্রু! অনেকেই যারা বলেন, আবেগ দিয়ে চলে না! তাদেরকে বলি ভাই, আবেগ ছাড়া চলেই না। আবেগ না থাকলে এইসব খেলা রান উইকেট জেতা-হারা সবকিছুই নস্যি মনে হতো। আবেগ না থাকলে কোথাকার তামিম সাকিব কী খেললো না কী করলো তা নিয়ে আমাদের কিছুই আসতো যেতো না! মাশরাফি বিন মুর্তজা এতগুলো অপারেশন করা পা নিয়েও খেলে গেছেন কেন জানেন? এটা ভালোবাসা, ক্রিকেটের প্রতি, দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি! এই আবেগটা না থাকলে কিছুই থাকতো না। মনে পড়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের সঙ্গে অমনভাবে হারার পরে মুশফিককে জড়িয়ে ধরে সাকিবের কান্নার কথা? সাকিবের যদি আবেগ নাই থাকে, সে যদি একদম লৌহ মানব হয়ে থাকে তবে সেদিন তিনি কেন কেঁদেছিলেন? কেঁদেছিলেন ওই আবেগের জন্যই, লালনের ওই গানে বলেছিল, পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না, তেমনি করেই বলতে হয়, আবেগ ছাড়া কিছুই চলে না।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |