বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় গুলিবিদ্ধরা
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
পুলিশের গুলিতে আহত ৭৬৮ জনকে ভর্তি করা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। তাদের মধ্যে ২১ জনের অঙ্গহানি হয়েছে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় তলায় মডেল-বি ওয়ার্ড। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত এই ওয়ার্ডে ভর্তি ঢাকার মিরপুরের ১২ বছর বয়সি শাহরিয়ার হাসান। নার্সরা তার বাঁ পায়ে ড্রেসিং করছেন, আর সে ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে। ঢাকার শেরেবাংলা নগরের এই হাসপাতালটি পঙ্গু হাসপাতাল নামেই বেশি পরিচিত। সংক্ষেপে এটি নিটোর নামেও ডাকা হয়। শাহরিয়ারের বেডের পাশেই ছিলেন তার মা সাদিয়া বেগম। কথা হলে তিনি বলেন, ঢাকার মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকায় থাকেন তারা। ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাদিয়া বেগম বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাইয়ে প্রথমে রাবার বুলেট লাগে শাহরিয়ারের শরীরে, যা সে পরিবারকে জানায়নি। দ্বিতীয়বার ৫ অগাস্ট মিরপুর-২ নম্বর এলাকায় পুলিশের শটগানের তিনটি গুলি লাগে তার দুই পায়ে। হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে শাহরিয়ারের মা জানতে পারেন তার ছেলে গুলি খেয়েছে। ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর কীভাবে জানতে পেরেছিলেন, সেই বর্ণনা দিয়ে সাদিয়া বেগম বলেন, “প্রথম দিন যে গুলি খাইছে, এইটা আমি জানতেই পারি নাই, জামাও খোলে নাই। এ জন্য দেখতে পারি নাই। ৫ তারিখ তারে কইলাম, মিটিং হচ্ছে বাইরে যাইস না। কোন ফাঁক দিয়া বাসা থেইকা বাইর হয়ে গেছে। ফোন পাইয়া হাসপাতালে আইসা দেখি ছেলের দুই পায়ে গুলি। “আমার দুইটা ছেলের মধ্যে শাহরিয়ার বড়। আমার স্বামী স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে আছেন। আমি বাসাবাড়িতে কাপড় বিক্রি করি। সে খেলাধূলায় অনেক ভালো, অনেক পুরস্কার পাইত। এখনও পায়।” ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়া এই মা বলছিলেন, “ডাক্তার বলছে, সে আর আগের মত স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে না। তার ভবিষ্যত কী হবে, বাসায় নিয়া গেলে পরবর্তী চিকিৎসার টাকা কোথায় পামু, সেই চিন্তায় আমার ঘুম আসে না।” শাহরিয়ার হাসানের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় দিন গুনছেন বৈষ্যমবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত ১৫ জুলাইর পর থেকে ১৯ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ৭০০ জনের বেশি মানুষের। এর মধ্যে পুলিশের গুলিতে আহত ৭৬৮ জনকে ভর্তি করা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। তাদের মধ্যে ২১ জনের অঙ্গহানি হয়েছে। ঢাকার শাহজাদপুরের বাসিন্দা ২৩ বছর বয়সি সোহাগ হোসেন মাসুম গত ৫ অগাস্ট বাড্ডার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে আহত হন। গুলি তার ডান হাতের হাড় ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। হাড় গুঁড়ো হয়ে যাওয়ায় দুই ইঞ্চির অংশের হাড় নেই। বাড়ি ফেরার জন্য মন কাঁদে, তবে কবে ফিরতে পারবেন, তা জানেন না সোহাগ। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না, তা নিয়েই বেদনায় ভোগেন সারাক্ষণ। এখন কী অবস্থা- জানতে চাইলে সোহাগ বলেন, “বাড়ির জন্য কত কষ্ট যে লাগে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝড়বৃষ্টি। কত কিছু যে মিস করছি! খালি আমার একা না, সবার অনুভূতি একই। কত তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হব, বাসায় ফিরব, স্বাভাবিক জীবনে ফিরব। মন খুব খারাপ লাগে। ডান হাতের দুই ইঞ্চি হাড়ই নাই। হাত অল্প অল্প নাড়াতে পারি, এই হাত আর জীবনে ঠিক হবে কি না, জানি না।” সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মো. সালমান হোসেনও নিটোরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, এখানকার অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবাই বাড়ি যেতে চায়। কিন্তু বাড়িতে গেলে চিকিৎসা ঠিকমত হবে না- এই চিন্তায় হাসপাতালও ছাড়তে চাচ্ছেন না কেউ। “বাড়ির জন্য মন সবারই কাঁদে, অনেক কষ্ট। কিন্তু এই বিকলাঙ্গ জীবন, পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে কি না, সেই শঙ্কা নিয়ে অনেকেই বাড়ির দিকে যাচ্ছে না। আরেকটা বিষয়ও দেখেছি, রিলিজ হওয়ার পর বাসায় গিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ না পেয়ে আক্রান্ত স্থানে সংক্রমণ নিয়ে আবার হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে কেউ কেউ।” ৫ অগাস্ট কুষ্টিয়ায় বৈষম্যবিরোধী মিছিলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন কুষ্টিয়া শহরের তরুণ জয় ইসলাম। তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা এক শিক্ষার্থীকে কয়েক বন্ধুর সঙ্গে উদ্ধার করতে যান। তখন তাদের ওপরও গুলি করে পুলিশ। তার ডান হাতে গুলি লাগে। অজ্ঞান অবস্থায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৬ অগাস্ট ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। এখনও এখানেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। জয় ইসলাম বলেন, গুলিতে হাতের বাহুতে যে ক্ষত হয়েছে, এত দিনে সেটাই পুরোপুরি শুকায়নি। তাই শুরু হয়নি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া হাড়ের চিকিৎসা । “ক্ষতের চিকিৎসা হচ্ছে, এটা শুকালে আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। দুই-তিন মাস পর আবার হাসপাতালে আসলে হাড়ের চিকিৎসা শুরু করবে। আমি পাথরের ওপর নাম খোদাইয়ের কাজ করতাম। আমার ডান হাত আর কোনো দিন ঠিক হবে কি না, জানি না; কীভাবে কাজ করব, তাও জানি না।” নিটোরের পরিচালক শামীমুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোববার পর্যন্ত এই হাসপাতালে ৯৮ জন রোগী ভর্তি আছেন। তাদের অবস্থা ভালোর দিকে। “তাদের কারও অবস্থাই খারাপের দিকে না। এখন যারা আছেন, তাদের পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। তাদের শরীরে ডিভাইসগুলো লাগিয়েছি, এখন তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এটা আনপ্রেডিক্টেবল যে, কতদিন সময় লাগবে; কারও তিন মাস, কারও চার মাস। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লাগবে।”
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |