ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
ই-পেপার |  সদস্য হোন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
জুয়ার টাকা বিট কয়েনে পাচার
নতুন সময় ডেস্ক
প্রকাশ: Saturday, 25 May, 2024, 11:27 AM

জুয়ার টাকা বিট কয়েনে পাচার

জুয়ার টাকা বিট কয়েনে পাচার

হাতে থাকা ইন্টারনেট সংযুক্ত স্মার্ট মোবাইল ফোনে জুয়ার সাইটে ঢুকলেই একটি ফোন নম্বর ভাসতে থাকে। এই নম্বরটিই মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের। সেখানে প্রয়োজনীয় টাকা পাঠালে শুরু হয় অনলাইন জুয়া। এভাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা যাচ্ছে জুয়ার দেশীয় ডিলারদের কাছে। সেই টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েনে রূপান্তর হয়ে পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে। হুন্ডিতেও পাচার হচ্ছে এই জুয়ার টাকা। সামান্য কমিশনের লোভে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হাজার হাজার ডিলার জড়িয়েছে এই পাচারকাণ্ডে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে মিলেছে এসব তথ্য।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), বিটিআরসিসহ বিভিন্ন সংস্থা এ অনলাইন জুয়া বন্ধে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। এই সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে কত লোক এই অনলাইন জুয়ায় জড়িয়েছে, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার ও সাইবার স্পেসে নজরদারি কার্যক্রম চালিয়ে সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট শাখার কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, জুয়ার বিভিন্ন সাইটে দেশ থেকে অন্তত ১২ লাখ নিবন্ধন রয়েছে। এর মধ্যে ৪ থেকে ৫ লাখ আইডিতে নিয়মিত জুয়া খেলা হয়ে থাকে। এসব আইডি থেকে মাসে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। দেশীয় ডিলারদের কমিশন বাদে বাকি সব টাকাই বিদেশে জুয়ার সাইটের মালিকদের কাছে চলে যাচ্ছে।

সম্প্রতি সংসদ অধিবেশনে সংসদ সদস্যের প্রশ্নে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেছেন, জুয়া ও হুন্ডির কারণে মুদ্রা পাচার বেড়েছে। এর ফলে সরকার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সময়ে দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) ও ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে লেনদেনের মাত্রা বহুলাংশে বেড়েছে। প্রযুক্তিগত এ উন্নয়নের সুবিধা কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু চক্র অনলাইন জুয়া-বেটিং, গেমিং, ফরেক্স, ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং, হুন্ডি প্রভৃতি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। ফলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ রেজাউল মাসুদ কালবেলাকে বলেন, অনলাইন জুয়ায় অর্থ পাচারে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস (এমএফএস) এজেন্টরা সরাসরি জড়িত। কারণ তারা অভিযান চালিয়ে দেখেছেন, অনলাইন জুয়ার সব টাকা যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এমএফএস অপারেটররা যদি তাদের এজেন্টদের নিয়ন্ত্রণ করেন, নিয়ম মেনে ব্যবসা করেন, তাহলেই এই জুয়া বন্ধ এবং অর্থ পাচার ঠেকানো সম্ভব। প্রযুক্তির যুগে জুয়ার সাইট বন্ধ করে ফল পাওয়া সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, সিআইডি বারবার এমএফএস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে এসব তথ্য তুলে ধরেছে। অনলাইন জুয়ায় কীভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা বৈঠকেও সিআইডি তুলে ধরেছে।

সিআইডি সূত্র জানায়, পাচারে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে গত কয়েক বছরে অন্তত ৫০ হাজার এমএফএস হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত অভিযোগে ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, এমএফএস কোম্পানিগুলোকে সন্দেহভাজন কয়েক হাজার এজেন্টের নম্বর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি কোম্পানি সজাগ হয়েছে। যদিও দেশে আরও ১২টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ে আর্থিক সেবা দিয়ে আসছে।

যেভাবে জুয়ার টাকা পাচারে জড়াচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা: সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, জুয়ার সাইটে লগইন করার পর দেশীয় মোবাইল ফোন অপারেটরের একটি ফোন নম্বর ভাসতে থাকে। সেখানে ক্লিক করে জুয়াড়ি যত টাকার খেলা শুরু করতে চায়, তা ওই নম্বরে পাঠাতে হয়। জুয়ায় জিতলে একইভাবে জুয়াড়ির মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে আসে লাভের টাকা। একাধিকবার খেলা চালালে ততবারই সংশ্লিষ্ট নম্বরে টাকা পাঠাতে হয়। যদিও সংশ্লিষ্ট জুয়ার সাইটে ওই নম্বরটি এক ঘণ্টা বা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। পরে নতুন নম্বর যুক্ত করা হয়। এই নম্বরটিই দেশের কোনো মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের পর একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুতে তারা ঘটনাটি বুঝতে পারেন না, গ্রাহক সেজে জুয়ার ডিলার এসে তাদের জানায়, নিয়মিত কিছু টাকা আসবে। নির্দিষ্ট পরিমাণে সেই টাকা আসায় তাদের সন্দেহও থাকে না। তবে বারবার বড় অঙ্কের টাকা আসতে থাকায় ঘটনা বুঝতে পারেন। একপর্যায়ে নিজেরাও লোভে পড়েন। কারণ তাদের যত লেনদেন, ততবেশি লাভ।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের একজন এজেন্ট নাম প্রকাশ না করে কালবেলাকে বলেছেন, এমএফএস কোম্পানিভেদে তারা টাকা প্রেরণ বা উত্তোলনে প্রতি হাজারে ৪ টাকা থেকে সাড়ে ৪ টাকা কমিশন পান। কিন্তু জুয়ার টাকা লেনদেন করা হলে প্রতি হাজারে ১০ টাকা বা তার চেয়েও বেশি টাকা কমিশন পাচ্ছেন ডিলারদের কাছ থেকে।

সিআইডি কর্মকর্তা মাসুদ রেজাউল বলছেন, একজন এজেন্ট তার নির্ধারিত ঠিকানায় থাকার নিয়ম রয়েছে। তা না হলে এজেন্ট নিবন্ধন বাতিল হওয়ার কথা। তা ছাড়া এমএফএস কোম্পানির নজরদারির লোকও রয়েছে, একজন এজেন্ট একটি এলাকায় কত টাকা লেনদেন করছেন। হঠাৎ লেনদেনের পরিমাণ বেশি হলে তো সন্দেহ হওয়ার কথা কোম্পানিরই। সেটা তারা ঠিকঠাক করলে জুয়ায় এমএফএস এজেন্টরা অপরাধে জড়াতে পারবে না।

বিদেশি জুয়া সাইটে দেশে ডিলার কারা: সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশে বসে অনলাইন জুয়ার অন্তত ১৫০টি সাইট, অ্যাপ, ইউটিউব ও ফেসবুক লিংক দেখা যায়। এর মধ্যে বেটইউনার, মোস্টবেট, বেট৩৬৫, মেইলবেট, এক্সবেট, ওয়ান এক্সবেট, মাইজেট, ক্রিকেক্স, ক্যাসিনো, বেটবাজি, বেটভেলকিসহ নানা নাম রয়েছে।

জুয়ার সাইট মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা সাইবার পুলিশের সদস্যরা বলছেন, এর প্রায় সব সাইটই বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়। কিন্তু দেশে তাদের ডিলার বা প্রতিনিধি রয়েছে। তারাই মূলত মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের কাছ থেকে জমা হওয়া জুয়ার টাকা সংগ্রহ করে। সেই টাকা বিট কয়েনে রূপান্তর করে তা পাচার করে বিদেশে মূল মালিকের কাছে।

এই ডিলাররা নিয়োগ হচ্ছে কীভাবে, তা জানতে চাইলে সিআইডির সাইবার সেন্টারের পরিদর্শক মর্যাদার একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, গত দুই বছরে তারা এ ধরনের অন্তত ২০০ ডিলার ও মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টকে গ্রেপ্তার করেছেন।

গ্রেপ্তার ডিলাররা জানিয়েছে, তারা মূলত জুয়া খেলতে গিয়েই জড়িয়ে গেছে। যাদের লেনদেন ভালো এমন লোকজনকে ডিলার নিয়োগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিদেশি নম্বরে বাংলাদেশি প্রবাসীরাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

অবশ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, অনেকে বিদেশে পড়ালেখা বা কর্ম সূত্রে গিয়েও জুয়ার সাইটের ডিলার হয়ে দেশে ফিরেছে। চলতি বছরের মার্চে ডিবির সাইবার বিভাগের সদস্যরা রাকিবুল ইসলাম রাতুল, আসাদুজ্জামান রাজু ও মামুন হাওলাদার নামে এই ধরনের তিন ডিলারকে গ্রেপ্তার করে। যারা চীনে গিয়েছিল পড়ালেখা করতে। সেখানে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে দেশে ফেরে জুয়ার এ দেশীয় এজেন্ট হয়ে।

ডিবি ও সিআইডির সাইবার পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব জুয়ার সাইটের প্রায় সবই রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সাইপ্রাস থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে সাম্প্রতিক নজরে আসা বেটবাজি ও বেটভেলকি সাইট দুটি দেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও এখনো এদের বড় গ্রাহক গড়ে ওঠেনি।

যেভাবে পাচার হয় জুয়ার টাকা: সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, জুয়া সাইটের এ দেশীয় এজেন্টরা প্রথমে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে। এরপর সেই টাকা অনলাইনভিত্তিক ‘বাইন্যান্স’ নামে অ্যাপে বিনিয়োগ করা হয়। এটি শেয়ারবাজারের মতো একটি অনলাইন অ্যাপ। সেখানে ডিলাররা টাকাকে ডলারে রূপান্তরের পর বিনিয়োগ করে। এরপর তা ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েনে রূপান্তর করে জুয়ার সাইট মালিকের কাছে পাচার করে থাকে।

সিআইডি কর্মকর্তা রেজাউল মাসুদ বলেন, এই বিট কয়েনে পাচারের বাইরে হুন্ডিতেও পাচারের প্রমাণ পেয়েছেন তারা। এজন্য বিদেশে আবার বাংলাদেশি প্রবাসীদের মাধ্যমে এজেন্ট গড়ে তুলেছে জুয়ার মাফিয়ারা। অনেক প্রবাসী না জেনেই এই এজেন্টদের সেখানে বৈদেশিক মুদ্রা তুলে দিচ্ছে, সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করছে তাদের স্বজনরা। পাশাপাশি কেউ কেউ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিও করছে এভাবে।

অনলাইন জুয়ায় লাভ পায় না কেউ: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে জুয়া খেলে কেউ লাভের মুখ দেখে না। সবাই ফতুর হয়। কিন্তু লোভ আর বিনোদনের জন্য এটা চলতে থাকে।

জুয়ার ডিলারদের ধরে সিআইডি জানতে পেরেছে, সাইটে এমনভাবে লগারিদম করা থাকে যে, একজন জুয়াড়ি ১০ বার খেলার জন্য টাকা বিনিয়োগ করলে সে ৬ থেকে ৮ বার জয়ী হয়। এতে জুয়াড়ির আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। এজন্য সে পরের খেলায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে থাকে। তবে তখন আর লাভের মুখ দেখতে পায় না জুয়াড়ি। অবশ্য সেই লোকসানের বিনিয়োগ তুলতে জুয়াড়ি নিয়মিতই বিনিয়োগ করতে থাকে এবং ফতুর হয়।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, তাদের সংস্থা নিয়মিতই অনলাইন জুয়া এবং এই জুয়ার অর্থ পাচার ঠেকাতে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর এজেন্টদের নজরদারি করে আসছে। এ ধরনের সন্দেহজনক তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা সিআইডিকে দিচ্ছে। পাশাপাশি অনলাইন জুয়ার সাইট দেখলে তা বন্ধ করতে বিটিআরসিকে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, দেশে জুয়া প্রতিরোধে পুরোনো আইন রয়েছে। তবে অনলাইন জুয়া বন্ধে সরকার নতুন ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

� পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ �







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: [email protected]
কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status