ভারতে চার দফায় ৩৮১টি আসনে ভোট হয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু গুজরাটের সুরাটে বিজেপির প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছেন, যা নিয়ে বিতর্ক সারা দেশে। ৮১ দিনের এই দীর্ঘ ভোট পরিক্রমায় মানুষের আগ্রহ একমাত্র একটি জায়গায়, তা হলো কে ক্ষমতায় আসছে? ব্যস্তসমস্ত জীবনে টি টোয়েন্টি দেখারই সময় নেই মানুষের, আর কোথায় এই টেস্ট ক্রিকেট। স্বাভাবিকভাবে ৭০ ভাগ আসনে ভোট হওয়ার পর জনগণের রায় কোন দিকে যাচ্ছে, তা জানতে চায় সবাই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে শুরু করেছিলেন, তাতে এই আগ্রহ থাকার কথা ছিল না। গত নভেম্বরে লোকসভায় দেওয়া ভাষণে মোদি ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিজেপি এবার একাই ৩৭০ পার করবে। আর জোট সঙ্গীদের নিয়ে সংখ্যা চার শ ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। ভোট আসতে তখনো ৩-৪ মাস বাকি। তাঁর বিরোধীদের ছন্নছাড়া অবস্থা। ফলে ভারতের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে বিজেপির সমর্থকেরা ধরেই নিয়েছিলেন ২০১৪ ও ২০১৯-এর পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে এবং তা আরও বড় আকারে।
কিন্তু লোকসভার ভোট কাছে আসতেই কেন জানি ছবিটা পাল্টাতে শুরু করল। বিশেষত কংগ্রেসের ইশতেহার প্রকাশ এবং ১৯ এপ্রিল প্রথম দফায় ভোট কম পড়ায়, একটু একটু করে ভিন্ন ভাবনা আসতে লাগল। পাল্টে গেল মোদি বিকাশ-উন্নয়ন তত্ত্ব, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার স্বপ্ন। ফিরে এল পুরোনো অথচ কার্যকর ধারালো অস্ত্র ‘মুসলমান-বিদ্বেষ’। রাহুল গান্ধীসহ বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কর্মসংস্থান না হওয়া, জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি, সংবিধান বদলে দেওয়ার সঙ্কল্পের অভিযোগের জবাব এল না, এল শুধু ধর্মাশ্রিত রাজনীতির বিষবাস্প।
বিজেপি নেতারা ব্যক্তিগত আলাপে মেনে নিলেন ‘আব কি বার চার শ পার’ সম্ভব না। এটা ছিল কথার কথা। এখন ২৭২-এর ওপরে থাকলেই তাঁরা খুশি। তবে তৃতীয় দফা নির্বাচনের পর নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর বিশ্বস্ত অমিত শাহ জোর দিয়ে বলছেন, চার শ পার করেই ছাড়ব। তবে সেই জোরের মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁপা আওয়াজ জায়গা করে নিয়েছে।
ওদিকে রাহুল গান্ধী আস্থার সাথে বলেছেন, লিখে নিন ৪ জুনের পর মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গীরাও একই কথা বলছেন বেশ জোর দিয়ে। এরই মধ্যে নির্বাচনী বন্ড বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ে বিজেপির মুখ পুড়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী জামিন দেওয়াটা মোদি সরকারের জন্য ছিল বিরাশি শিক্কার থাপ্পড়ের মতো। তাই তো গুজরাটের নির্বাচন শেষ হতেই উত্তরপ্রদেশ ও বিহার নিয়ে পড়ে আছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দুটো রাজ্য মিলে ১২০টি আসন। ২০১৯-এ বিজেপি জোট পেয়েছিল ১০৩টি আসন। এবার এর ধারে–কাছে না থাকতে পারলে বিপদ যে আসন্ন, তা মোদি-শাহ জুটি ভালোই বুঝেছেন। কারণ, এবার কোনো মোদি হাওয়া নেই। বরং কোনো চোরা হাওয়া থেকে থাকলে তা মোদির বিরুদ্ধে।
নির্বাচনের ফল নিয়ে যাঁরা ভবিষ্যৎবাণী করেন, ইংরেজিতে তাঁদের সেফলজিস্ট বলে। এমনই একজন হলেন যোগেন্দ্র যাদব। তিনি গত ৩৫ বছর ধরে এই কাজ করছেন। এখন রাজনৈতিক কর্মী। আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। কিন্তু কেজরিওয়ালের সাথে বিরোধে আর সেখানে থাকা হয়নি। নিজেই একটা দল গঠন করেছেন। মূলত হরিয়াণা-কেন্দ্রিক। রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়োযাত্রার সাথী। তিনি হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর পাশাপাশি কর্ণাটকেও গেছেন। তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা শুধু সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেছেন। কোনো সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বললে তিনি বলেই দেন, ‘আমি ৩৫ বছর ধরে ভোট নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করছি ঠিকই, কিন্তু এখন আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। সুতারাং আপনারা আমার কথায় পুরোপুরি আস্থা না রেখে নিজেরাই যাচাই করুন।’
এহেন যোগেন্দ্র যাদব যখন নিজে যেচে এসে ভারতের ভোটের ফল নিয়ে কিছু বলেন, তখন গুরুত্ব দিতেই হয়। কেন তিনি যেচে এসে এ কথা বললেন তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, মোদি ও শাহরা যেভাবে আবার ‘চার শ পার’ প্রচারে নেমেছেন, বাস্তবতা তো সেটা না। তাঁর দেওয়া তথ্য প্রকাশের আগে বলে নেওয়া ভালো, ২০১৯ সালে ৫৪৩ সদস্যের লোকসভায় বিজেপি একাই পেয়েছিল ৩০৩টি আসন এবং বিজেপি জোট হিসেবে এনডিএ পায় ৩৫৩।
যোগেন্দ্র যাদব বলছেন, বিজেপি একাই এবার কমপক্ষে ৭৫টি আসন হারাবে। শুধু তামিলনাড়ু, কেরালা ও তেলেঙ্গানায় ৫টি আসন পেতে পারে। তবে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তাঁর হিসাবমতে, তৃতীয় দফার নির্বাচন শেষে বিজেপি একা সর্বোচ্চ ২৩৩ এবং এনডিএ ২৬৮ আসন পেতে পারে। তিনি বলছেন, এটা তাঁর অত্যন্ত রক্ষণশীল হিসাব। অর্থাৎ, মোদির দল ও জোটের আসন আরও কমতে পারে।
এবারে আসি ফোর পিএম নিউজের সম্পাদক সঞ্জয় শর্মা ও আলোচক রাজীব রঞ্জন সিংহের আলোচনায়। দুজনই সাংবাদিক হিসেবে ভারতের একাধিক বড় বড় টিভি চ্যানেলে কাজ করেছেন। এখন সঞ্জয় থাকেন দিল্লিতে। আর রাজীবের আবাস নাগপুরে, আরএসএস-এর সদর দপ্তর যেখানে। গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবির দেওয়া তথ্যের উল্লেখ করে রাজীব দাবি করছেন, বিজেপি নয় এনডিএ জোট পাবে মাত্র ১৯০টি আসন। অর্থাৎ, মোদির ক্ষমতায় ফেরা দুরস্থান। সঞ্জয়ের দাবি, তাঁর কাছেও আইবির এই হিসাব আছে। রাজীবের কথায়, আইবির হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৮টি আসন পাবে বিজেপি, অর্থাৎ ১০টি হারাবে। মহারাষ্ট্রে পাবে ২২টি, গতবার এনডিএ জোট হিসেবে পেয়েছিল ৪৮টির মধ্য ৪১টি।
বিজেপি বা এনডিএ জোটের এই অকল্পনীয় আসন কমার অনুমানেরও একটা ব্যাখ্যা রাজীব সিংহ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস ৩৫২টি আসন পায়। যদিও সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটা বড় ভূমিকা ছিল নিঃসন্দেহে। পরের নির্বাচন ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস পায় মাত্র ১৫৪ আসন। ইন্দিরা নিজে হেরে যান। ১৯৯৯ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে এনডিএ পেয়েছিল ৩৩৯ আসন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা নেমে আসে ১৮৯-এ। অথচ সবাই নিশ্চিত ছিল ‘সাইনিং ইন্ডিয়ায়’ ভর করে বাজপেয়ি আবার ক্ষমতায় আসতে চলেছেন। ২০০৯ সালে মনমোহন সিং-এর কংগ্রেস পায় ২০৬টি আসন। আর ২০১৪-তে ৪৪ আসন পাওয়া কংগ্রেসকে লোকসভায় হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজতে হয়েছে। ফলে এবার যদি এনডিএ ৩৫৩ থেকে ১৯০-এ নেমে আসে, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটাই রাজীবের বক্তব্য। তবে ভোটের আগের জরিপের সাথে এই হিসাবের আকাশপাতাল পার্থক্য হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, মোদির ধামাধারী সংবাদমাধ্যম বা জনমত জরিপ সংস্থা—কারও মাঠের সাথে সম্পর্ক নেই। নিজেদের তৈরি জনপ্রিয় ধারণার ওপর ভিত্তি করে এসব জরিপ করা হচ্ছে।
এবার আসা যাক ভোটের ফল নিয়ে বাজি ধরার গল্পে। বাজি ধরা বা প্রকারন্তরে জুয়া আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের এখানেও ক্রিকেট নিয়ে হরহামেশা জুয়ার খবর গণমাধ্যমই দিয়ে থাকে। এই বাজি বা জুয়া হিন্দিতে সাট্টা নামেই পরিচিত। রাজস্থানে এমনই সাট্টার বাজার আছে। সারা ভারতে তা ব্যাপকভাবে পরিচিত। এর নাম ফালুদি সাট্টা বাজার। ভারতে যেকোনো স্পর্শকাতর বিষয়ে এই ফালুদি সাট্টা বাজার কী বলছে, তাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। লোকসভা নির্বাচন শুরুর আগে এই সাট্টা বাজারের হিসাবে এনডিএ জিততে চলেছিল ৩৪০ থেকে ৩৫০টি আসন। অর্থাৎ, মোদির জয়জয়াকার। তৃতীয় দফা ভোটের শেষে এনডিএর এই হিসাব নেমে এসেছে ২৭৫-২৮৫তে। বাকি চার দফা ভোটের পর কী হবে কে জানে? তবে ফালুদি সাট্টা বাজারের হিসাবমতে, এখনো মোদিই দিল্লির মসনদে ফিরছেন। এখানে চিন্তার বিষয় হলো এনডিএর ২৭৫ আসন পাওয়ার ওপর বাজি ধরার লোক প্রায় পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন সেখানকার সাংবাদিকেরা।
যে যাই বলুন ৪ জুন বোঝা যাবে কে ঠিক, কে ভুল। তবে ভারতের একজন প্রবীণ সাংবাদিকের মতে বিজেপি ও কংগ্রেস মিলে ৩১০ থেকে ৩২০টি আসন পাবে। এর মধ্যে বিজেপি বেশি পেলে কংগ্রেস কম পাবে। আর কংগ্রেস বেশি পেলে বিজেপির ভরাডুবি। ভোটের পর এই দুই দলের বাইরেও আঞ্চলিক দলগুলো জোট বেঁধে সরকার তৈরি করতে পারে। তেমন নজির ভারতেই আছে।