১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয় এলেও সেই বিজয়ের পূর্ণতা আসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিতে। কারণ মুক্ত হয়ে সেদিনই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক, মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে ঢাকায় আসার পথে ব্রিটিশ সরকারের বিশেষ কমেট বিমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ভারতীয় কর্মকর্তা ভেদ মারওয়া।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। তবে দেশে ফেরার আগেই অর্থাৎ লন্ডন থেকে দিল্লিতে যাত্রাবিরতি দিয়ে দেশে ফেরার আগে বিমানে বসে মাঝ-আকাশেই নানা পরিকল্পনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যা হয়তো জানা নেই সবার।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে তার সফরসঙ্গীদের দেয়া সাক্ষাৎকার ও প্রকাশিত নিবন্ধের তথ্যানুযায়ী, বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি পর্যন্ত ১৩ ঘণ্টার যাত্রাপথ এবং এরপর সেখান থেকে দেশে পৌঁছানোর আগেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, বাংলাদেশের পরিচয় কী হবে কিংবা দেশের জাতীয় সংগীত কী হবে- রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় ভেবে ফেলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তবে এর বাস্তবতা বুঝতে হলে ফিরতে হবে কিছুটা পেছনে।
কারাগারে রেখে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে সামরিক আদালতে বিচারের নামে চলতে থাকে প্রহসন। কিন্তু এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়া যে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং ষড়যন্ত্রমূলক, দ্রুতই তা উপলব্ধি করতে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহল। ফলে ১৬ ডিসেম্বর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী যখন আত্মসমর্পণ করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও নিয়াজীর শহর মিয়ানওয়ালি সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে আটকেপড়া নিয়াজীর শহরকে শেখ মুজিবের জন্য নিরাপদ মনে না করায় তাকে কয়েক দিনের জন্য অজ্ঞাত এক স্থানে সরিয়ে নেন জেল সুপার শেখ আব্দুর রশিদ। এরপর ২৬ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় শিহালায়। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো।
বঙ্গবন্ধু তখনও জানতেন না, এ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়েছে। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তারা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে এসেছে, আর পূর্ব পাকিস্তানের নাম হয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর এই না জানার সুযোগ নিয়ে ভুট্টো বলার চেষ্টা করছিলেন, সময় আছে একসঙ্গে থাকার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি বাংলাদেশে ফিরতে চাই।’ অবশেষে বঙ্গবন্ধুকে সে আশ্বাস দিলেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে হরিপুর জেল থেকে ড. কামাল হোসেনকেও শিহালায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কিছু জটিলতা দেখা দেয় তার যাত্রাপথ নিয়ে।
বঙ্গবন্ধু সরাসরি বাংলাদেশে ফিরতে চাইলেও পাকিস্তানের সরকারি বিমান সংস্থা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বিমান ভারতীয় সীমানার ওপর দিয়ে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বঙ্গবন্ধুকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাতেই লন্ডনে যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। ৭ জানুয়ারি মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে পিআইএর একটি বিশেষ বিমান ইসলামাবাদ ত্যাগ করে। যাত্রাপথে বিমানটি করাচি থেকে কামাল হোসেনের স্ত্রী ও দুই মেয়েকে তুলে নেয়।
ঠিক হয়েছিল, লন্ডনে পৌঁছানোর এক ঘণ্টা আগপর্যন্ত এই বিমান ভ্রমণ সম্পর্কে কোনো ঘোষণা দেয়া হবে না। যেসব দেশের ওপর দিয়ে বিমানটি যাবে তাদের বলা হবে এটি পাকিস্তানের কৌশলগত কার্গো বহনকারী একটি বিমান। বঙ্গবন্ধু লন্ডন পৌঁছেছিলেন ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টার দিকে।
সেদিনই ব্রিটেনে ভারতীয় হাইকমিশনারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি বার্তা পাঠান তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দেশে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধুকে দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করারও অনুরোধ জানান তিনি। শেখ মুজিব তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। পরদিন অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার জন্য ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডন ত্যাগ করেন। লন্ডন থেকে দিল্লি পর্যন্ত তার সফরসঙ্গী হন দুই ভারতীয় কূটনীতিক, ভেদ মারওয়া ও শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। তাদের মধ্যে শশাঙ্ক ব্যানার্জি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পূর্বপরিচিত। দূরদর্শিতার প্রতীক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা
ভেদ মারওয়াকে নিজের পাশের আসনে বসিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। যখন বুঝেছিলেন মারওয়া বাংলা জানেন, তাদের মধ্যে দ্রুত একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়। তিনি ড. কামাল হোসেন ও তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে টানা কথা বলেছিলেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিমানযাত্রার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মারওয়া বলেন, ‘বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিব সেদিন বেশ চাঙা ছিলেন। সব কিছুতেই তার মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ কাজ করেছিল।’
সেই সময় শেখ মুজিব বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করেছিলেন বলেও জানান মারওয়া। তিনি বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) মূলত দুটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রথমত, বাংলাদেশে জনসংখ্যার আধিক্য। শেখ মুজিব বলেছিলেন, এত মানুষ কোথায় যাবে? এখনো যেসব স্থানে জনসংখ্যার আধিক্য দেখা দেয়নি, কেবল সেসব স্থানই তাদের গন্তব্য হতে পারে। এক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের উচিত পরষ্পরকে সহযোগিতা করা। স্বাভাবিকভাবেই ওই মুহূর্তে আমি এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিলাম। আমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে মুজিব নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারতকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, একপর্যায়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পরিচয় কী হবে, তা নিয়ে কথা বলা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘দেখো, আমরা প্রথমে বাঙালি। এটা বাংলাদেশিদের বহুস্তরবিশিষ্ট পরিচয়ের একটি। আমরা এ পরিচয় নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। এ পরিচয়কে ভিত্তি করেই স্বাধীনতার সব আন্দোলন–সংগ্রাম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমরা মুসলিম। তৃতীয়ত, আঞ্চলিক পরিচয়।’ তিনি বলছিলেন, ‘এ অঞ্চলের সমস্যাগুলো খুব বেশি অভিন্ন। পরষ্পরের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ছাড়া এসব সমস্যা সমাধানের অন্য কোনো উপায় নেই।’
মারওয়ার ভাষ্যে, ‘আপনি কল্পনা করতে পারেন, একজন মানুষ কতটা আত্মবিশ্বাসী হলে দায়িত্বভার গ্রহণের আগেই এমন সব কথা বলতে পারেন। তার ব্যক্তিত্বের এই প্রখরতা ওই সময় আমার মধ্যে গভীর দাগ কেটেছিল। শেখ মুজিবের কথায় মনে হচ্ছিল পুরো বাংলাদেশটাই তার হাতের মুঠোয়। তিনিই যেন বাংলাদেশ।’
ভারতীয় এ কূটনীতিক আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নিজেকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। তার সব চিন্তা ছিল বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি জানতেন না, তার ভাগ্যে কী আছে। কী ঘটতে পারে, এটা নিয়েও তার মধ্যে চিন্তার ছাপ ছিল না। বন্দি জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। তার কথাবার্তায় ঘুরেফিরে আসছিল সদ্য জন্ম নেয়া বাংলাদেশের নানা সমস্যার কথা। আমাকে বলা কথাগুলো ঢাকায় অবতরণের পর রেসকোর্স ময়দানে দেয়া সেই বিখ্যাত ভাষণেও তিনি বলেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, বিমানে ভ্রমণের সময়ই তিনি বক্তৃতায় কী বলবেন, তা মনে মনে গুছিয়ে রেখেছিলেন।’
সেদিন বিমানে শশাঙ্ক ব্যানার্জিকেও বঙ্গবন্ধু তার পাশের আসনে বসিয়েছিলেন। সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সুগন্ধময় এরিনমোর তামাক, আর ছিল সেই বিখ্যাত পাইপ। উৎফুল্ল বাঙালি নেতার তখন দেশে ফেরার বিলম্ব সহ্য হচ্ছিল না। শশাঙ্ক ব্যানার্জিকে আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ তিনি ব্যানার্জিকে ধন্যবাদ জানান দীর্ঘদিন তাকে সহযোগিতার জন্য। বলেন, ‘ব্যানার্জি, এবার একটি বিশেষ সহযোগিতা চাই।’
শশাঙ্ক উত্তর দিলেন, ‘আয়ত্তের মধ্যে হলে অবশ্যই চেষ্টা করব।’ বঙ্গবন্ধু তখন বলেন, ‘দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগেই তার কাছে একটি খবর পৌঁছানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।’
শুধু তাই নয়, বিমানে বসেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ঠিক করেছিলেন। এর বর্ণনায় শশাঙ্ক ব্যানার্জি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু তার স্বাধীনতার স্বপ্নকালীন সময় থেকেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’-এটি গুন গুন করে গাইতেন। বিমানেও তিনি সেটি গুন গুন করে গাইতে থাকলেন। হঠাৎ বললেন, ব্যানার্জি তুমি গান গাইতে জানো? অবাক হয়ে বললাম, আমি তো গানের কিছুই জানি না। তিনি বললেন, আরে তাতে কী! তুমি আমার সঙ্গে ধরো। বলেই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। ড. কামাল হোসেনসহ পেছনে বসা অন্যদেরও দাঁড়াতে বললেন এবং তার সঙ্গে গান ধরতে বললেন। তিনি খুব দরদ দিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে থাকলেন। আর তখন তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকল।
ব্যানার্জির ভাষ্যে, ‘একজন মহান নেতার গভীর দেশপ্রেম ও মাতৃভূমির প্রতি পরম ভালোবাসা আমাকে আবার মুগ্ধ করল। গান গেয়ে তিনি যখন বসলেন, তখন আমি আমার কূটনৈতিক প্রথা ভেঙে একজন দেশপ্রেমিক নেতাকে বললাম, বঙ্গবন্ধু, আপনাকে আমি প্রণাম করতে পারি? তিনি কিছু বলার আগেই আমি তার চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলাম। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, এটি (আমার সোনার বাংলা) হবে আমার স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত। এতদিন বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী উৎফুল্ল চেহারা দেখেছি। এবার আমি তার ভেতরের কোমল মানুষটির দেশপ্রেমিক রূপ দেখলাম। যেটি তখনকার দিনের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কমই দেখা যেত।’ ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন
এবার এল দিল্লি থেকে ঢাকায় ফেরার পালা, ঐতিহাসিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতীয় একটি বিশেষ বিমানে (রাজহংস) করে ঢাকায় ফেরার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। তবে সেই যাত্রার আগে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন তিনি। আর ওই বৈঠক চলাকালীনই শেখ মুজিবুর রহমানের ভ্রমণসূচিতে বড় পরিবর্তন আসে।
ভারতীয় প্লেনে নয়; যে ব্রিটিশ বিমানে দিল্লিতে এসেছেন, সেটিতে করেই ঢাকায় ফেরার ইচ্ছার কথা জানান বঙ্গবন্ধু। পথিমধ্যে কলকাতায় নেমে যে এক গণভাষণ দেয়ার প্রোগ্রাম ছিল, তা-ও বাতিল হয়। পরে জানা যায়ু বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়ের অত্যন্ত সংগত কারণগুলো।
বঙ্গবন্ধু তার সফরসঙ্গী ও সংশ্লিষ্টদের জানান, যে বিমানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তাকে ঢাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, তা মাঝপথে পরিবর্তন শিষ্টাচারসম্মত হবে না। তবু তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচারপ্রধান (সিপি) ফারুক চৌধুরীকে ডেকে তার অনুমান নিশ্চিতকরণের কথা বলেন। দিল্লিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্সকে ফোন করতেই তিনি জানালেন, সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকার এয়ারপোর্টের বর্তমান অবস্থা যাচাই করার পরই তাদের প্লেন নির্ধারিত হয়েছে।
সঠিকভাবেই বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন, কলকাতায় জনসভার জন্য যাত্রাবিরতি হলে তিনি সূর্যালোকে ঢাকায় হয়তো পৌঁছাতে পারবেন না। আলোকস্নাত ঢাকায়ই তিনি তার প্রিয় দেশবাসীকে দেখতে চান, কথা বলতে চান।
বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতাবাসী বাংলাদেশের গৃহত্যাগী জনগণকে আশ্রয় দিয়ে যে মহানুভবতা ও সম্প্রীতির মনোভাব দেখিয়েছে, সেজন্য তিনি কলকাতায় গিয়েই তার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে চান।
অল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এমন কূটনীতির শিষ্টাচারজ্ঞান, দেশপ্রেম, ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মসম্মানবোধ ও তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা সবাইকে বিস্মিত করেছিল।
পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজাদ, রাষ্ট্রাচারপ্রধান ফারুক চৌধুরী ও লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসা ড. কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী হামিদা হোসেন, বন্ধু জনাব মাওলা ও সাংবাদিক আতাউস সামাদ একই বিমানে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হলেন।
শেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা কমেট বিমানটি যে মুহূর্তে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করল, যেন কোনো জাদুময় কিছু ঘটে গেল। প্রতীক্ষায় থাকা লাখো জনতা যেন অপেক্ষা করে ছিল অনন্তকালের জন্য, তার সমাপ্তি ঘটল।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই দেশে পৌঁছানোর আগেই ভেবে ফেলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমন নিরলস নেতা পৃথিবীতে খুব কমই জন্মান। আমরা এখন যা ভাবি বঙ্গবন্ধু হয়তো সেটা ভেবে ফেলেছিলেন কয়েক দশক আগেই।