ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ: ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম কালো আইন
কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন
|
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ: ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম কালো আইন বেনিফিশিয়ারি জিয়া ’৭৫-এর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আর্কিটেক্ট বিখ্যাত সাংবাদিক Lawrence Lifschulty-এর একটি উদ্ধৃতি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য- ‘Ziaur Rahman was passively involved in the assassination of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman.’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেস। তার মধ্যে- ১। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যুক্তরাজ্যে যে অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয়েছিল তার সদস্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি জেফরি টমাস ও তার সহকারিকে ’৮১ সালে বাংলাদেশে আসতে বাধা দেন জিয়াউর রহমান। ২। বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দেয়ার কারণে জার্মানিতে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ওএসডি করা হয়। ৩। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার কন্যাদের দেশে আসতে দেননি জিয়াউর রহমান। কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার মেয়াদ উত্তীর্ণ পাসপোর্ট যাতে নবায়ন না করে তার জন্য লন্ডন দূতাবাসকে অফিসিয়ালি নির্দেশ দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার পাসপোর্ট নবায়ন করায় ভারতে নিযুক্ত সেই সময়ের রাষ্ট্রদূতকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ৪। ’৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করা হয় (যা বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণয়ন করেছিল), কারাগারে আটক ও দণ্ডিত সব যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া হয়, ’৭৬ সালে সেকেন্ড প্রক্লেমেশন অর্ডার নং-৩/১৯৭৬ জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাবলী তুলে দেওয়া হয়। সেকেন্ড প্রক্লেমেশন ঘোষণা জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রক্লেমেশন অর্ডার নম্বর-ক ১/১৯৭৭ জারি করে দালালদের সংসদে নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ তুলে দেওয়া হয়। প্রক্লেমেশন অর্ডার নম্বর-১/১৯৭৭ দ্বারা সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের রাজনীতি করার সুযোগ দেন জিয়া। ৫। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী এবং রাজাকার আলীমকে মন্ত্রী বানানো হয়। শহীদ পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু যে সকল বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক ওইসব বাড়ি থেকে শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে উৎখাত করেন। বঙ্গবন্ধু ’৭৩ সালে ১৮ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম গংয়ের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ’৭৮ সালে গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। জিয়াউর রহমান ’৭৭ সালে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের বেছে বেছে হত্যা করেন। প্রতি রাতে কার্ফু দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয় ওই সময়। ৬। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতার নেতৃত্বের ইতিহাস নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু শব্দের প্রতিও জিয়াউর রহমানের ভীতি ছিল। জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়া- বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারি জেনারেল এরশাদ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দিয়ে ফ্রিডম পার্টি গঠন করিয়ে খুনিদের প্রটেকশন দেন, বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেন।জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ’৯১ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর সকল হত্যাকারীকে পদোন্নতি দেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কালো দিন। ’৯৩ সাল থেকে খালেদা জিয়া এই বেদনাবিধুর দিনে মিথ্যা জন্মদিন উদযাপন করেন, কেক কাটেন। এই বর্বরতম কাজ করে খালেদা জিয়া মূলত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বুকে ছুরি চালান। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনি রশিদ এবং হুদাকে এমপি বানান খালেদা জিয়া। খুন রশিদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে সংসদকে কলুষিত করেন খালেদা জিয়া। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত ও মামলা পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগীদের অনৈতিক ও বেআইনি কার্যকলাপ: ’৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সংসদে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স রহিতকরণে বিল আনা হয়। সেদিন বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত ছিল। প্রশ্ন ওঠে, কেন তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত ছিল? জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শুধু সুরক্ষা বা পুরস্কৃতই করেননি, আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া দায়রা জজ আদালত কর্তৃক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন হরতাল পালন করেন। ২০০১-এর অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। আইনের চলমান প্রক্রিয়া বন্দি হয় রাজাকারের প্রকোষ্ঠে। শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তুলে দেওয়া হয় যুদ্ধাপরাধী নিজামী-মুজাহিদদের কাছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার উচ্চ আদালতের চলমান প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। অতঃপর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন সুপ্রীম কোর্ট। আপীলকারী ৫ আসামির আপীল খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন সুপ্রীম কোর্ট। আইনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি আসামিদের সাজা কার্যকর করা হয়। জাতি কলঙ্ক থেকে আংশিকভাবে মুক্ত হয়। বস্তুত আমাদের লড়াইটি এখনও রয়ে গেছে। পালিয়ে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৬ খুনির দণ্ড কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বাঙালির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটতেই থাকবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করতেই খুনিরা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ করে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গ, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, শিশু শুকান্ত বাবুকে হত্যা করে মানবতার বুকে কুঠারাঘাত করে। খুনিরা শুধু একজন নেতাকে নয়, জাতির পিতাকে হত্যা করে। একটি আদর্শকে হত্যা করতে চেয়েছে। খুনির দল জানেনা আদর্শকে হত্যা করা যায় না, স্বপ্নকে হত্যা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু অমর, অব্যয়, অক্ষয়। এই নৃশংস ঘটনায় রাষ্ট্র তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি, বিচারের পদক্ষেপ নেয়নি বরং খুনিদের পুরস্কৃত করে, দায়মুক্তি দিয়ে সারাবিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করে খুনির রাষ্ট্রে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের মদদদাতা ও রক্ষা কর্তাদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা অগাধ, যার সন্ধান পাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে- ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা।’ বাঙালি জাতির প্রতি এই অক্ষয় ভালবাসাই- পাকিস্তানের মিয়াওয়ালির কারাগারে ভুট্টো-ইয়াহিয়া যে কবর খুঁড়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য, বাঙালির প্রতি সেই ভালবাসার এমনই অপার শক্তি যা বঙ্গবন্ধুকে তার ইপ্সিত লক্ষ্য থেকে এক চুলও নড়াতে পারেনি। বাঙালির মুক্তির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত ছিলেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। এটি শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচারের পথ প্রশস্ত করে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেন বাংলাদেশ হাইকোর্ট। মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিচার দীর্ঘ ২১ বছর পরে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য শুরু করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় মামলা দায়েরের মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আসামি পক্ষের ১৫ জন উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পান। উক্ত আপিলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল এবং ৩ জনকে খালাস প্রদান করা হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এ মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পরে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার এ বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিল-এর মাধ্যমে এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন মহামান্য আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি এদের মধ্যে পাঁচ জনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বাকি ছয় জন এখনও বিভিন্ন দেশের আশ্রয়ে পলাতক। পলাতকদের মধ্যে একজন এরই মাঝে বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু জিয়া যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরোধী হতেন, তিনি যদি ঘাতকদের বিচার চাইতেন তাহলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের অংশ না করে তা বাতিল করতেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনৈতিক পদে নিরাপদ চাকরি না দিয়ে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতেন। জিয়া জাতীয় ঐক্যের মুখোশ পরে কার্যত দেশকে এক ভয়াবহ বিভেদের পথে ঠেলে দিয়েছেন। দুঃখের বিষয় হলো, জিয়ার অবর্তমানেও তার দল বিএনপি সেই খুনি পোষণের নীতি থেকে বের হতে পারেনি। অথচ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি নতুন বিএনপির প্রত্যাশাই দেশবাসীর ছিল। ১৫ আগস্টের কলঙ্ক মোচনের পথে একটি বড় অগ্রগতি ঘটে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর। কারণ এইদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরণ বিল পাসের মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের খুনিদের দায়মুক্তির অবসান ঘটে। ১২ নভেম্বর দিনটি তাই বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বস্তির দিন, বুকে চেপে থাকা পাথর সরে গিয়ে হালকা অনুভবের দিন। ইনডেমনিটি বাতিলের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ শুধু সুগম হয়নি, বছরের পর বছর অপেক্ষার পর নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়। কয়েকজন এখনও পলাতক জীবন যাপন করছে। তবে তারা আর আস্ফালন করতে পারছে না। দেশের বুকে বিচারহীনতার যে ঘৃণ্য সংস্কৃতি চালু করা করা হয়েছিল, তারও অবসান ঘটেছে। তাই ১২ নভেম্বর দিনটি আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ববাহী একটি দিন। ইতিহাস তো এমন নানা দিন-তারিখ সুসময়-দুঃসময় এবং ঘটনা-দুর্ঘটনারই সমষ্টি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ওইদিনই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সাথী। তিনি যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন তাতেও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই। সে কারণে এটা অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে, বঙ্গবন্ধুর ঘাতক আসলে আওয়ামী লীগই। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ হত্যাকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার যোগসাজশ ছিল, বঙ্গবন্ধু-হত্যা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, কেউ কেউ গ্রহণ করেছেন সুবিধাবাদী অবস্থান– এ সবই সত্য। কিন্তু তাবা বলে এটা ঠিক নয় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যায় দলগতভাবে আওয়ামী লীগ জড়িত ছিল। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। এই আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করেই তো বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন, জেলজুলুম সহ্য করেছেন, বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে একটি মহল নিজেদের আড়াল করতে চায়। এটা যে মহল বিশেষের একটি কূটকৌশল- এটা মনে রাখতে হবে, বুঝতে হবে। আওয়ামী লীগ থেকে বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করা, বিছিন্ন করার রাজনৈতিক চাতুরী বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আর সে সময় যেহেতু বিএনপি নামক দলটিই ছিল না, তাই বিএনপির জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না! যুক্তি হিসেবে এগুলো উপেক্ষা করার মতো নয়। তবে কিছু ঘটনা মিলিয়ে দেখলে এটা স্পষ্ট হয় যে জিয়াউর রহমান, তার দল এবং নেতৃত্ব কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু হ্ত্যায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে জিয়াউর রহমান অবশ্যই ছিলেন না। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার বড় বেনিফিশিয়ারি জিয়া। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে জিয়ার পক্ষে কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া সম্ভব হতো? এই যে আজ তার অনুসারীরা ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া' বলে সম্বোধন করে তৃপ্তি বোধ করেন- এটা তো বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হতো না। বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় জিয়া তখন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ছিলেন। এখন এ তথ্য জানা যে, তার সঙ্গে ঘাতকদের যোগাযোগ ছিল। তিনি জানতেন তারা কী করতে চান। কিন্তু তিনি তাদের বাধা দেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকেও সতর্ক করেননি। ঘাতকরা শিখণ্ডি হিসেবে বেছে নিয়েছিল খন্দকার মোশতাককে। তবে ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে ছিল ঘাতকবাহিনী। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। কিন্তু সামরিক আইন জারি করা হয় ২০ আগস্ট, তাও আবার সংবিধান বহাল রেখে। আর জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয় ২৪ আগস্ট। ঘাতকদের আস্থাভাজন না হলে কি জিয়া এই পদ পেতেন? ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের কোনো বিচার করা যাবে না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা করা যাবে না– এই মর্মে দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, জিয়া সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস পর। সেনাপ্রধানের সম্মতি ছাড়া মোশতাক এই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, জিয়াকে না জানিয়েই খুনিদের মদদে মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, তাহলেও প্রশ্ন আসে, জিয়া যখন রাষ্ট্রক্ষমতা পুরো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন, তখন কি তিনি এই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিলের চেষ্টা করেছিলেন? অথবা ১৫ আগস্টের খুনিদের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহার করেছিলেন? জিয়া ছিলেন চতুর মানুষ। তিনি মেশতাকের মতো বোকা ছিলেন না। জিয়া তাড়াহুড়া না করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন। সেজন্য মোশতাক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচিত হলেও জিয়া হয়ে আছেন অনেকের কাছে ‘মহান দেশপ্রেমিক’। জিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল হিসেবি, সুপরিকল্পিত। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া কার্যত ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন। কিন্তু ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণকারী বিচারপতি সায়েমকে তিনি কিছুটা সময় দেন। তারপর প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ কেড়ে নেন বিচারপতি সায়েমের হাত থেকে। অতঃপর রাষ্ট্রপতি পদ থেকেও তাকে বিদায় করে জিয়া হয়ে বসেন ক্ষমতার প্রধান ব্যক্তি। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া সামরিক আইনের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। ওই নির্বাচনে দলছুট, সুবিধাবাদী এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিয়ে জিয়ার নবগঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি বিস্ময়করভাবে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে রেকর্ড তৈরি করে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় রাজাকার শিরোমণি শাহ আজিজকে। অথচ জিয়া নিজে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক আইনের আওতায় জারি করা সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে বৈধতা দেওয়া হয় এই সংসদে। এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করেন শাহ আজিজ । ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এভাবেই হয়ে যায় সংবিধানের অংশ। অথচ এটা ছিল একটি সভ্যতাবিরোধী, বর্বর ব্যবস্থা। জিয়া যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরোধী হতেন, তিনি যদি ঘাতকদের বিচার চাইতেন তাহলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের অংশ না করে তা বাতিল করতেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনৈতিক পদে নিরাপদ চাকরি না দিয়ে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতেন। জিয়া জাতীয় ঐক্যের মুখোশ পরে কার্যত দেশকে এক ভয়াবহ বিভেদের পথে ঠেলে দিয়েছেন। দুঃখের বিষয় হলো, জিয়ার অবর্তমানেও তার দল বিএনপি সেই খুনি পোষণের নীতি থেকে বের হতে পারেনি। অথচ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি নতুন বিএনপির প্রত্যাশাই দেশবাসীর ছিল। জিয়ার পর এরশাদও ক্ষমতা দখল করে ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচারের কোনো নতুন পদক্ষেপ নেননি। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির রাজনীতি ছিল মূলত আওয়ামী লীগ বিরোধিতার রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা হলে আওয়ামী লীগের লাভ হবে-এই বিবেচনা থেকেই খুনিদের বিচারে অনীহা দেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া দুজনই আওয়ামী লীগকে চাপে রাখার জন্য খুনি ফারুক-রশীদের দল ফ্রিডম পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার অপচেষ্টাও করেছেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে। দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তনের সুযোগ পেয়েও তা হাতছাড়া করে বিএনপি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের জন্য একটি বিল জমা দেওয়া হলেও তা বিবেচনা করেনি বিএনপি। বরং তৎকালীন আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ বলেছিলেন, ইনডেমনিটি আইনটি এতই জটিল যে তা প্রত্যাহার অযোগ্য। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনারা নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটির মতো একটি কালো অধ্যাদেশ বাতিলে কোনো সমস্যা হলো না। ১২ নভেম্বর এই জঘন্য অধ্যাদেশ বাতিল হওয়ায় পর বঙ্গবন্ধ হত্যার বিচারের পথে যে আইনি বাধা তৈরি করা হয়েছিল, তার অবসান ঘটে। রাষ্ট্রপিতাকে সপরিবারে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটনের পরও যারা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতো যে, তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই, তাদের দম্ভ চূর্ণ হয়েছে। অপরাধ করলে তার শাস্তি পেতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করেছেন তারই কন্যা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিহাসের এই দায় মেটানোর জন্যই হয়তো তিনি বেঁচে আছেন, ১৫ আগস্ট ছিলেন বিদেশে। ইতিহাস কাউকে মার্জনা করে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বলেছেন, একসময় ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাসও প্রতিশোধ নেয়। বাংলাদেশে ইতিহাস প্রতিশোধ নিয়েছে। যারা ষড়যন্ত্র করে, যারা গোপনে অস্ত্র শান দেয়, হত্যা-ক্যুয়ের মাধ্যমে যারা ক্ষমতা বদলের স্বপ্ন দেখে, যারা সোজা পথ রেখে বাঁকা পথে হাঁটতে পছন্দ করে, তাদের জন্য দুঃসময় তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা তার সাহসী সিদ্ধান্ত এবং জনকল্যাণকর কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। করোনাভাইরাসের আঘাতে মুজিব বর্ষ উদযাপন ব্যাহত হলেও মুজিব আজ বাঙালির হৃদয়জুড়ে। তিনি আছেন এবং তিনি থাকবেন। তিনি চিরঞ্জীব। |
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |