ডলার সংকটের শেষ কোথায়
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
|
![]() ডলার সংকটের শেষ কোথায় এটি হয়েছে, কারেন ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) পরামর্শ মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করছে বলে। গত বুধবার সকালে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১০ টাকা। বিকালে এই নতুন পদ্ধতিতে তা ৭ টাকা বৃদ্ধি করে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একটা সময় ডলারের তুলনায় টাকার দর একটু বেশিই ছিল। কৃত্রিমভাবে জোর করে টাকার দাম বেশি দেখানোর প্রবণতা থেকে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ সত্ত্বেও তা সমন্বয় করা হয়নি। এখন আর টাকার দাম ধরে রাখতে পারছে না। বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অর্থনীতির যুক্তি যা-ই হোক, রাজনৈতিক দিক থেকে ঘোর অস্বস্তিতে সরকার। কারণ টাকার দরে পতনের ফলে সব থেকে বেশি ধাক্কা লাগবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পকেটে। তেলের দাম বাড়লে ক্ষোভের পারদ চড়বে। রপ্তানিকারকরা কিছুটা সুবিধা পেলেও তাদের পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঠিকই বেশি করে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। বাড়বে বিদেশে বেড়ানো বা পড়াশোনার খরচ। বিদেশি ঋণ শোধেও গুনতে হবে বাড়তি কড়ি। বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার নির্ধারণে বাজারভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে বাংলাদেশকে বহুদিন ধরে তাগাদা দিয়ে আসছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। ২০২২ সালের প্রথমদিকে বাংলাদেশ ঋণের আবেদন করার পর থেকেই আর্থিক খাতের বিভিন্ন নীতি সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে আসছে আইএমএফ। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে নানামুখী উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না। সংবাদমাধ্যমে খবর আসছে যে, বাজারভিত্তিক ডলারের দর নির্ধারণের পর খোলাবাজার থেকে ডলার উধাও হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে ডলার সংকটে বৈদেশিক বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থায় পড়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা রপ্তানি খাতে। এলসি খুলতে হলে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। খোলাবাজারে কোথাও কোথাও ১২৮ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ছাড়া আর কোনো উপায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে ছিল না। বাংলাদেশে অর্থনীতিতে ডলারের দর নির্ধারিত থাকা কঠিন। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ঘোষণা করতে হয়েছে। এতে কালোবাজারে বা ডলার পাচারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। তবে হঠাৎ করে এই পদ্ধতির জন্য বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে যে যে কথাই বলুক না কেন, ব্যবসায়ীরা জানতে চায় ডলার সংকট কাটবে কবে? দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলার সংকট বিরাজ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক সময় ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছলেও তা এই সংকটের কারণে হ্রাস পেয়ে ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে গেছে। আর সে কারণেই ডলারের দামেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। বর্তমান গভর্নর মার্চের মধ্যে ডলার সংকট কেটে যাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাবে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। ডলার সংকট কাটেনি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়েনি। তাই প্রশ্ন জেগেছে সত্যি কি এবারের ডলার সংকট সমাধানের উপায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আছে? অপ্রয়োজনীয় বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সেটা পুরোপুরি মানা সম্ভব হচ্ছে না। সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খুলছে না। এমনকি রপ্তানিমুখী পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে খোলাবাজার থেকে ডলার কিনছেন ব্যবসায়ীরা। এ ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম পড়ছে এখন ১৩০ টাকার কাছাকাছি। কোনো কোনো আমদানিকারক ডলারের বেশি দাম নিয়ে চিন্তা করছেন না, যে কোনো মূল্যে তাদের ডলার চাই। অথচ বেশি দাম নিয়েও ডলার দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বেশি খরচ দিয়ে পণ্য আমদানি করে উৎপাদন করতে চাইলেও তা করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। কারণ ব্যবসায়ীরা ডলার পাচ্ছেন না। ডলারের দাম বাড়ার কথা শুনে বিদেশ থেকে যারা নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাতেন তারা সেটা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ফলে রেমিট্যান্সের ডলার দিয়ে আর আমদানির পেমেন্ট করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। প্রবাসীরা ভাবছেন ডলারের দাম আরও বাড়বে। তাই তারা ডলার ধরে রাখছেন। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে যাওয়া বাংলাদেশে ডলার সমস্যার প্রধান কারণ। যতদিন ডলার প্রবাহ না বাড়ছে ততদিন সংকট কাটবে না। এখন তা হলে করণীয় কী সেটাই বড় বিবেচনা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন অপ্রয়োজনীয় বিলাস পণ্য আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে। ডলার ছাড়াও অন্য দেশের সঙ্গে মুদ্রাচুক্তিতে (কারেন্সি সোয়াপ) যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু এগুলো আসলে টোটকা পদ্ধতি। সমস্যা সমাধান করতে হলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধির বিকল্প নেই। রপ্তানি বহুমুখীকরণ অনেক দিনের চাওয়া, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। আমাদের দেশের রপ্তানি খাত শুধু তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। তৈরি পোশাকের মতো অন্যান্য খাতেও প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরেও রপ্তানি বাজার তৈরি করা জরুরি। ডলার সংকট নিরসনের আরেকটি উপায় হলো বেশি করে বিদেশি বিনিয়োগ দেশে নিয়ে আসা। বাজার নিয়ন্ত্রণে ক্রলিং পেগ চলুক, তবে দেশকে বিনিয়োগবান্ধব করতে পারলে এমনিতেই ডলারের ইনফ্লো বাড়বে। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : সিনিয়র সাংবাদিক |
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |