এমপি আনারের ফ্ল্যাটে রহস্যময় নারী, যে সব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না
শাওন আজহার
প্রকাশ: Wednesday, 22 May, 2024, 10:17 PM
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারের মৃতদেহ উদ্ধার নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের যে ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ, সেখানে কোনো মরদেহ মেলেনি। এর মধ্যেই এ ঘটনায় নতুন আরেক রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তারা দুটি মোবাইলের নেটওয়ার্ক ট্র্যাক করছিল। সেখান থেকেই দেখা গেছে, সঞ্জিভা গার্ডেন্সই এমপি আনারের শেষ লোকেশন ছিল। এরপরই পুলিশের তদন্তকারী দল সেখানে যায় এবং সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে। সেই ফুটেজ খতিয়ে দেখে পুলিশের তদন্তকারী দলের সদস্যরা নিশ্চিত হন, এমপি আনার সেখানে গিয়েছিলেন এবং তিনি একাই সেখানে যান।
কিন্তু এরপরই এমপি আনারের ওই ফ্ল্যাটে ঢোকেন পরপর তিনজন। তারমধ্যে একজন নারীও ছিলেন। এই তিনজনকে আবার কিছুক্ষণ পরই কয়েক দফায় বেরিয়েও যেতে দেখা যায়। এছাড়া ওই ফ্ল্যাটে ঢোকার জন্য তড়িঘড়ি করে ৩-৪টি গাড়িও আসা-যাওয়া করে। সেই নারীকে নিয়েও রহস্য দেখা দিয়েছে। আসলে কে তিনি?
জানা গেছে, সেই গাড়ির সূত্র ধরেই এখন তদন্ত চলছে। আরও কিছু অ্যাপ ক্যাবের নেটওয়ার্ক ও তার চালককে এরমধ্যেই আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন গোয়েন্দারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা প্রাথমিকভাবে এমপি আনারের নিখোঁজ রহস্যের সাতটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন। প্রশ্নগুলো হলো- প্রশ্ন ১: একজন সংসদ সদস্য কেন সঙ্গীহীন ভারতে এলেন? প্রশ্ন ২: তার সঙ্গে কেন মাত্র একটি হ্যান্ডব্যাগ ছিল? প্রশ্ন ৩: সীমান্ত অতিক্রম করার সময় কে ধারণ করল ১ মিনিটের ভিডিও? প্রশ্ন ৪: কার গাড়িতে বরাহনগর থেকে উঠে গেলেন এমপি আনার? প্রশ্ন ৫: ফোনে কথা না বলে যে ক্ষুদে বার্তা দিলেন সেটা কি আদৌ তার লেখা? প্রশ্ন ৬: আট দিন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মাত্র দুদিন মোবাইলের লোকেশন ট্র্যাক করা সম্ভব হয়। পরে হঠাৎ কেন ট্র্যাক করা যাচ্ছে না?
দূতাবাসের কর্মকর্তাদের একটি দল বরাহনগর ১৭/৩ মন্ডলপাড়া লেনের গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে। এছাড়াও কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। তাদের কয়েকজন শীর্ষ গোয়েন্দা বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে গিয়ে নিখোঁজ আনার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা- আইবি কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে তদন্ত শুরু করে। দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছিল, বাংলাদেশ ও ভারতের দুটি সিম কার্ড এই মুহূর্তে ইনঅ্যাক্টিভ। হ্যান্ডসেটের মধ্যে নেই। তাই সংসদ সদস্যের মোবাইল ট্র্যাক করা যাচ্ছে না।
তবে দুটো মোবাইলের লোকেশন ট্র্যাক করে প্রথম দুদিন বিভ্রান্ত হন গোয়েন্দারা। বাংলাদেশের নম্বরটি বেনাপোল এলাকা দেখায় এবং ভারতীয় নম্বরটি বিহারের মুজাফরপুর দেখায়। এরপর থেকে ওই দুই নম্বরের লোকেশন আর ট্র্যাক করার চেষ্টা বাদ দেয়া হয়।
গোয়েন্দারা যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন এর মধ্যে একটি হলো- বাংলাদেশের একজন এমপি ভারতের চিকিৎসা করাতে একা এলেন কেন?
এমনিতেই জনপ্রতিনিধিদের সাথে সব সময় কেউ না কেউ থাকেন কিংবা তার ব্যক্তিগত সচিবও থাকেন। এ ক্ষেত্রে তিনি একা সীমান্ত অতিক্রম করলেন, সেটাও মাত্র হালকা একটা ব্যাগ নিয়ে। এর মাঝে কেউ তার একটা ভিডিও করলেন, সেখানেও দেখা যাচ্ছে এমপিকে হাস্যোজ্জ্বল।
তাকে যে কেউ জোর করে তুলে নিয়ে যায়নি সেটাও অভিযোগপত্রে পরিষ্কার লেখা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একটি গাড়িতে করে এমপি নিজেই হেঁটে উঠেছেন এবং সেই দৃশ্য একজন দেখেছেনও।
এরপর কোথায় গেলেন? কিংবা তার মোবাইল থেকে পাঠানো ক্ষুদে বার্তাগুলো যে স্টাইলে লেখা ওই স্টাইলে সাধারণত আনার লেখেন না বলেই তার পরিচিতরা বলছেন। তবে কে লিখল আনারের মোবাইল থেকে ওই ক্ষুদে বার্তা?
আর আনার যদি স্বেচ্ছায় গাড়িতে উঠে ডাক্তার দেখাতে যান তবে তার মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল কেন? মোবাইল হ্যান্ডসেট থেকে সিমই বা খোলা ছিল কেন?
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের ঘটনায় তিনজনকে আটক করার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, ‘খুনের সাথে বাংলাদেশিরাই জড়িত।’
গতকাল ধানমন্ডির বাসভবনে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। এমপি আনার খুনের ঘটনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ভারতের সাথে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তারা আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের ফাটল ধরবে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কারণ ভারতের কেউ এখানে জড়িত নন। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে, আমাদের দেশের মানুষই হত্যায় জড়িত।
মরদেহ পাওয়া গেছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে আমরা এখনই আমাদের কাছে থাকা সব তথ্য প্রকাশ করছি না। কেন খুন হয়েছে, কোথায় খুন হয়েছে, কারা জড়িত- তদন্ত শেষে আমরা সবই জানাব। মরদেহ এখনও আমাদের হাতে আসেনি। ভারতের পুলিশ জানিয়েছে, তিনি খুন হয়েছেন, এটা সুনিশ্চিত। কলকাতার একটি বাসায় তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আটক তিনজন আমাদের হেফাজতে আছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। যারা যারা এই খুনের সাথে জড়িত, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল আমরা প্রকাশ করতে পারব। আমরা আরও কয়েকজনকে ধরার চেষ্টা করছি।’ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার ঘটনায় মূলহোতাসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
আনোয়ারুল আজীম ১২ মে চিকিৎসার জন্য দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। ১৬ মে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনি।
আনারের জন্ম ৩ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে। পেশায় ব্যবসায়ী আনার আওয়ামী লীগ কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি তৃতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে তিনবার (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) নির্বাচিত আনার একজন ক্রীড়া সংগঠক এবং একসময়ের জনপ্রিয় ফুটবল খেলোয়াড়।