ভানুয়াতুতে ১০৭ বাংলাদেশির দাসের জীবন
নতুন সময় ডেস্ক
|
সুখের সন্ধানে ভিনদেশে পাড়ি জমানো মানুষগুলো কি সবসময় সুখি হয়! হয়তো কেউ হয় কিন্তু সুখ খুঁজতে গিয়ে সর্বস্ব হারানো মানুষদের গল্পটা লোমহর্ষক। বিশ্বে অভিবাসী পাঠানোর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বেশিরভাগই দালালের পাল্লায় পড়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। ভানুয়াতু নামক দ্বীপরাষ্ট্রে ভাগ্য ফেরাতে গিয়ে তেমনি সর্বস্বান্ত হয়ে দাসের জীবন কাটিয়েছেন ১০৭ বাংলাদেশি। কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনি লোমহর্ষক বর্ণনা। বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর শাহিন। দেশে ভালই চলছিল তার কাপড়ের ব্যবসা। কিন্তু উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমান প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতুতে। প্রতারকের পাল্লায় পড়ে দেশটিতে কাটিয়েছেন দাসের জীবন। পাননি কোনো বেতন এমনকি দুবেলা খাবার। শিকার হয়েছেন শারীরিক নির্যাতনের। আল-জাজিরাকে তিনি এসব বর্ণনা করেছেন। দেশ ছাড়ার আগে ভাবতেও পারেননি তার সামনে অপেক্ষা করছে নারকীয় জীবন। ৫০ বছর বয়সী শাহীনকে বলা হয়েছিল, একজন কোটিপতি উদ্যোক্তার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সেই উদ্যোক্তার রয়েছে পোশাকের ব্যবসা। জায়গায় জায়গায় আছে দোকান। কিন্তু এসবের কিছুই পাননি শাহীন। উল্টো আধুনিক ‘দাসত্বের’ শিকার হতে হয়েছে। এমনকি প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে তাকে। শাহিন বলেন, নিজেকে একটি জীবন্ত মৃতদেহ বলে মনে হয়েছিল। এখানে খুবই অল্প খাবার দেওয়া হতো। দাসের মতো পরিশ্রম করানো হতো। আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। আমার মনোবল ভেঙ্গে গেছে। আমার সব স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ধুলোয় মিশে গেছে। ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভানুয়াতুতে এসে প্রতারণার শিকার ১০০ জনের বেশি বাংলাদেশি পুরুষের মধ্যে শাহিন একজন। নেপথ্যে রয়েছেন, সেকদাহ সুমন নামক এক পাচারকারী। তিনি নিজেকে একটি ফ্যাশন বুটিকের আন্তর্জাতিক চেইন এর মালিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। প্রকল্পের কাজের কথা বলে তাদের এই দেশে নিয়ে আসতেন। পাঁচ বছর আগে শাহীন ও তার সঙ্গে থাকা অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে প্রতারণা ও অকথ্য নির্যাতনের এ ঘটনা জানাজানি হয়। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, এখনো অনেকেই ‘উন্নত জীবনের’ আশায় ভানুয়াতুর মতো দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে অবৈধ অভিবাসী আর দাসত্বের জীবনই যাপন করতে হচ্ছে তাদের। যেভাবে ফাঁদে পড়েন শাহিন ২০১৮ সালের জুন মাসে টাঙ্গাইলের একটি বাস স্ট্যান্ডে শাহিনের পরিচয় হয় সেকদাহ সুমনের সহযোগীদের সঙ্গে। শাহিনকে বলা হয় সুমন একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী। সারা বিশ্বে রয়েছে পোশাকের ব্যবসা। তাদের কথা শুনে বিশ্বাস হয়নি শাহিনের। তাই সে নিজে একবার যাচাই করতে চেয়েছেন। তাকে বলা হয়েছিল, সুমন দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড মিস্টার প্রাইসে কাজ করেন। তারপর এই ব্র্যান্ড সম্পর্কে অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি করেন তিনি। অনলাইনে খুঁজতে গিয়ে ভানুয়াতুর একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখতে পান শাহীন। ওই প্রতিবেদন থেকে জানতে পারেন, ভানুয়াতুতে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছে মিস্টার প্রাইস। ওই প্রতিবেদনে সুমন ও ভানুয়াতুর কয়েকজন মন্ত্রীর কথাও লেখা ছিল। এসব দেখে একসময় ভরসা পান শাহিন। সব দেখে ভানুয়াতু যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন পোশাক বিক্রেতা শাহীন। তার ব্যবসাও ভালোই চলছিল। সেই ব্যবসা দেখিয়ে ঋণ নেন। চাকরি নিয়ে ভানুয়াতু যাওয়ার জন্য সহযোগীদের মাধ্যমে সুমনকে কয়েক হাজার মার্কিন ডলার দেন। ব্যাগ গুছিয়ে স্ত্রী–সন্তান আর পরিবারের সদস্যদের বিদায় জানিয়ে ফ্লাইটে উঠে পড়েন। শাহীনের ভানুয়াতু যাওয়ার এ ঘটনা পাঁচ বছর আগের। এখনো তার দেশে ফেরা হয়নি। ভানুয়াতুর রাজধানী পোর্ট ভিলার বিমানবন্দরে অবতরণ করার পরই সুমনের লোকজন তার পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে তাকে সমুদ্রপারের পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে রাখে। সেখান থেকে শাহীনকে কোথাও যেতে দেওয়া হতো না। শাহীন ভানুয়াতুতে পৌঁছানোর দিন কয়েকজন বাংলাদেশি তাকে ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে যান। সুমনের হয়ে কাজ করা এসব বাংলাদেশি তাকে নির্যাতন করেন। এখানে শেষ নয়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর কাছ থেকে নেয় আরও ১৪ হাজার ডলার। তাকে খাবার হিসেবে দেওয়া হতো বাঁধাকপি আর ভাত। এক অনুষ্ঠানে তাকে মাংস দিয়ে বলা হয়, এটা মৃত গাভীন গরুর মাংস। মন চাইলে খেতে পারো যদি তোমার প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। ভানুয়াতুর পাবলিক প্রসিকিউটর অবশেষে ২০২২ সালে সুমন, তার স্ত্রী নাবিলা বিবি এবং দুই সহযোগীকে মানব পাচার, দাসত্ব, অর্থ পাচার, হত্যার হুমকি, হামলা এবং দেশের কর্মসংস্থান আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করবেন। ২০২২ সালে চার আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করার সময় ভানুয়াতুর প্রধান বিচারপতি ভিনসেন্ট লুনাবেক তার রায়ে লিখেছেন, ‘সেকদাহ সুমন স্বীকার করেছেন তিনি ভুক্তভোগীদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেওয়া, তাদের কেটে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া, জঙ্গলে নিয়ে নির্যাতন এবং ফ্রিজে রাখা ইত্যাদি করেছেন। সবসময় তাদের জুমকির ওপরে রাখতেন তিনি। এমনকি বলা হতো তাদের মেরে ছবি তুলে সেগুলো পরিবারের কাছে পাঠানো হবে।’ একদিন সুযোগ বুঝে আরও দুইজনকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে আসে শাহিন। এরপর তিনি স্থানীয় থানায় এসে সব খুলে বলেন। তদন্তকারীরা বলেছেন, ভানুয়াতুতে ব্যবসায়িক কোনো উদ্যোগই ছিল না সুমনের। সে শুধু অভিবাসীদের এনে অত্যাচার এবং ব্ল্যাকমেইল করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা চাইতো। সুমনকে গ্রেপ্তার করার পর প্রথমে অস্বীকার করেন যে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। নিজেকে জিম্বাবুয়ের নাগরিক বলে দাবি করেন তিনি। পরে তদন্তকারীরা জানতে পারেন তার পাসপোর্ট জাল। ঝুঁকিতে বাংলাদেশ মানব পাচারের বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানব পাচারের ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার এসব মানুষের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হলো বাংলাদেশি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বাংলাদেশ মিশনের প্রধান আবদুস সাত্তার ইজোয়েভ বলেন, মানব পাচারের শিকার মানুষের সিংহভাগকে বড় ধোঁকা দেওয়া হয়। বলা হয়, তিনি বিদেশে গেলেই তার পরিবার ও সন্তানের উন্নত জীবন নিশ্চিত। তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণে অনেক ব্যক্তি তার সহায়–সম্পত্তি ও আজীবনের সঞ্চয় বিনিয়োগ করেন। বিশেষ করে উন্নত দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটা বেশি। কিন্তু শেষে গিয়ে দেখা যায়, তারা মানব পাচারের শিকার। এতে ঋণগ্রস্ত, জোরপূর্বক শ্রম, নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয় তাদের।’ এই পরিস্থিতি প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশিকে এজেন্টদের দ্বারা পাচারের ঝুঁকিতে ফেলে যারা বিদেশে ভালো চাকরি এবং লাভের জাল প্রতিশ্রুতি দিয়ে অভিবাসীদের প্রতারণা করে বা শোষণ করে। নিয়োগকারীদের কেউ কেউ নিজেরাই পাচারের শিকার হয়েছেন। সুমন এখনও ভানুয়াতুর কারাগারে ১৪ বছরের সাজা ভোগ করছেন। তার স্ত্রী এবং দুই সহযোগীকে প্রায় অর্ধেক দীর্ঘ সাজা দেওয়া হয়েছিল, তবে এই বছরের শুরুতে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং জরিমানা দেওয়ার পরে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। চার অপরাধীকে ১০৭ জন ক্ষতিগ্রস্থকে মোট ১০ লাখ ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হলেও এই পরিমাণ অর্থ তারা পায়নি। তবে শাহিনের অগ্নিপরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। ভানুয়াতুতে তার অভিবাসন অবস্থা অচলাবস্থায় রয়েছে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে শরণার্থী মর্যাদা অর্জনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। শাহিন এখনো সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখেন।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |