গ্রুপ সিআইবি রিপোর্টের বেড়াজালে ভয়াবহ সংকটে ব্যবসায়ীরা
বিভিন্ন ব্যাংকের স্বেচ্ছাচারিতা ও অতি সতর্কতার কারণে একটি খারাপ ইউনিটের জন্য গ্রুপের ভালো ইউনিটগুলো ঋণ সুবিধা হারাচ্ছে
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনশীল খাতের একাধিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই গ্রুপগুলোর পরিচালনায় থাকে একাধিক পরিচালক। তবে কোনো পরিচালক অনিচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হলে, পুরো গ্রুপ বিপদে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবির নিয়মের বেড়াজালে, একটি খারাপ ইউনিট থাকলে পুরো গ্রুপের ভালো ইউনিটগুলো ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে পারছে না। অর্থাৎ একই গ্রুপ অব কোম্পানির পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে একটি খারাপ হলে সে ইউনিটের সিআইবি যদি খেলাপি হয়, তাহলে ওই গ্রুপের বাকি চারটি ইউনিট ব্যাংকগুলোয় ফ্যাক্টরির কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ বেকার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে এবং ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে মনে করেন অংশীজনেরা। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি, ডলার–সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ঋণপত্র খুলতে সমস্যা, সুদহার বৃদ্ধি, কাঁচামাল–সংকট, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসায়ীরা । বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এখন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন, যেখানে একটি কোম্পানির খারাপ অবস্থা পুরো গ্রুপের সিআইবি রিপোর্টকে প্রভাবিত করছে। এই পরিস্থিতিতে, গত বছরের জুলাই মাসে ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবর্তন এনে ইচ্ছাকৃত খেলাপি না হলে শিল্প গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। কিন্তু বিভিন্ন শর্তের কারণে প্রকৃত শিল্প গ্রুপ এই সুবিধা নিতে পারছেন না। সরকারের উচিত, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা জানান, ‘বিভিন্ন ব্যাংকের স্বেচ্ছাচারিতা ও অতি সতর্কতার কারণে গ্রুপ সিআইবি রিপোর্টের যদি একটি কোম্পানি অনিচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক সুবিধা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং তাদেরও খেলাপি হিসেবে ধরা হচ্ছে । এ প্রথা বাতিল করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের অধিকাংশ ঋণ নেয় বড় বড় কোম্পানি, ব্যবসায়ী গ্রুপ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঋণ বাংলাদেশে অনেক কম।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী বলেন, "এক পরিচালকের ব্যক্তিগত ঋণ খেলাপির কারণে আমার রপ্তানির ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি আটকে গেছে। শুধুমাত্র একজন পরিচালকের সামান্য খেলাপির জন্য ব্যাংক ২,০০০ মতো কর্মীর চাকরি ঝুঁকির মুখে ফেলছে।" এ প্রসঙ্গে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞদের মত হলো, ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের ধারা ৫(গগ) অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার ঋণখেলাপি হলে কোম্পানি আইনের চোখে খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। সেহেতু একই গ্রুপের একটি খারাপ ইউনিটের জন্য অন্য ভালো ইউনিটগুলোকে প্রভাবিত করা আইনের ব্যত্যয়। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়টি আইনের আলোকে যথাযথভাবে বিবেচনায় না নেওয়ায় দেশের অর্থনীতির ওপর অযথা নেতিবাচক এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও প্রতিকূল পরিস্থিতি বিবেচনায়, ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় শিল্প গ্রুপগুলো সিআইবি রিপোর্টের বাধ্যবাধকতা সম্পূর্ণভাবে স্থগিত করার জোর দাবি জানাচ্ছে। তারা মনে করছে, এটি স্থগিত হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। তারা বলেন,‘বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের দাম বাড়লেও, দেশি বাজারে মূল্য সমন্বয় হচ্ছে না। এর ফলে অনেক ব্যবসায়ী অনিচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। কোনো শিল্প গ্রুপের একটি ইউনিট খারাপ হলে, পুরো গ্রুপের সব ইউনিট খারাপ চিহ্নিত করা উচিত নয়। সরকারের উচিত এই বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা।’ অংশীজনেরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। ব্যবসায়ীদের হাত ধরে বাংলাদেশ বর্তমান উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। প্রতি বছর সরকারি পর্যায়ে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হয়, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয় বেসরকারি খাতে। এক একটি গ্রুপ অব কোম্পানিতে রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। এর মধ্যে কোভিড মহামরি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন, শিল্পের কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরবর্তীতে গ্রুপ অব কোম্পানিগুলোর কিছু ইউনিট ভালো থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দু-একটি ইউনিট। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করে বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রুপ অব কোম্পানির ক্ষেত্রে যদি সিআইবি রিপোর্ট স্বস্তিদায়ক না করে, তাহলে অচিরে বড় বড় গ্রুপগুলোর সব ইউনিট একসঙ্গে বন্ধ হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। আর যদি খারাপ ইউনিটের সাময়িক সিআইবি রিপোর্ট খারাপ থাকে, তবুও যদি ভালো ইউনিটগুলোর ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রাখা হয়, তবে ভালো ইউনিটের আয় দিয়ে খারাপ ইউনিটগুলোকে ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। সরকারকে এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। অন্যথায়, খেলাপি ঋণ বাড়তে পারে এবং ব্যাংকিং খাত মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |