সৌন্দর্যের আড়ালে মৃত্যুর ফাঁদ!
নতুন সময় প্রতিবেদক
|
মিরসরাইয়ের ঝরনাগুলোতে সাত বছরে নিহত ২৩ পর্যটক, ইজারা দিয়ে দায় সারছে বন বিভাগ চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের পাহাড়ি ঝরনাগুলো যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর বিশেষ করে বর্ষাকালে ঝরনায় পানি বেশি থাকায় পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে যান পর্যটকরা। ঝরনায় পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত না করা, পর্যটকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ না করা, পাহাড়ি পথ সম্পর্কে পর্যটকদের অভিজ্ঞতা না থাকা, সাঁতার না জানা ও প্রশিক্ষিত গাইডের অভাবে বাড়ছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। জানা গেছে, উপজেলার খৈয়াছড়া, রূপসী, নাপিত্তাছড়া, সোনাইছড়ি, বোয়ালিয়া ও মহামায়া বুনো ঝরনা দেখতে যান দূরদূরান্তের পর্যটকরা। নানা প্রতিকূলতা ও অব্যবস্থাপনায় গত ৭ বছরে এসব ঝরনায় ২৩ জন পর্যটক প্রাণ হারান। আহত হয়েছেন শতাধিক। এছাড়া গাইড ছাড়া বিভিন্ন ঝরনায় যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে গভীর জঙ্গলে চলে যাওয়া শতাধিক পর্যটককে উদ্ধার করেছে পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিস টিম। তবুও টনক নড়েনি ইজারাদার ও বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের। জানা গেছে, মিরসরাইয়ে বিভিন্ন পাহাড়ে অবস্থিত পাঁচটি প্রাকৃতিক ঝরনা ইজারা দেয় বন বিভাগ। বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের অধীনে ঝরনাগুলো দেখাশোনা করা হয়। প্রত্যেক বছর ইজারামূল্য বাড়লেও পর্যটকদের জন্য এখনো নিরাপদ হয়ে ওঠেনি ঝরনাগুলো। পর্যটকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। ঠিকাদারের কাছে ঝরনা ইজারা দিয়ে দায় সারে বন বিভাগ। এসব ঝরনা দেখতে এসে নিহত হচ্ছেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ভ্রমণ পিপাসুরা। ঝরনায় মৃত্যু ঠেকাতে গত বছর মেলখুম ট্রেইল ও চলতি বছরের গত ২৮ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনা সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে বন বিভাগ। তবে সংস্কার শেষে গত ৪ অক্টোবর খৈয়াছড়া ঝরনা পর্যটকদের জন্য পুনরায় উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। স্থানীয়দের দাবি, ঝরনা দেখতে আসা সিংহভাগ পর্যটক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া। এদের মধ্যে অনেকে সাঁতার না জানার কারণে ঝরনার নিচে থাকা কূপে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর উপজেলার রূপসী ঝরনায় ছবি তুলতে গিয়ে কূপের পানিতে ডুবে মুশফিকুর রহমান আদনান (২১) ও মাহবুব রহমান মুত্তাকিম (২১) নামের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনায় ছয় জন ঘুরতে এসে পাথর পড়ে মাহবুব হাসান (৩০) নামের ওয়ান ব্যাংক কর্মকর্তা নিহত হন ও গাজী আহমেদ বিন শামস (৩৫) নামে আরেক জন গুরুতর আহত হন। গত ৩ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝরনার কূপে ডুবে সিফাতুর রহমান মজুমদার (২০) নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। গত ২০ আগস্ট একই এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কুমিল্লার লালমাইয়ের ছোট শরিফপুর এলাকার বাসিন্দা অঞ্জন বড়ুয়া (২১) ও একই এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল হক (২২) নামে দুই পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন ঝরনা এলাকায় মারা যান আরো কিছু পর্যটক। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ৩০ লাখ টাকায় ঝরনাগুলো ইজারা নিয়েছে সোমোশন এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে থাকা শাহরিয়র মাহমুদ আসিফ বলেন, ঝরনায় আসা সিংহভাগ পর্যটক এলাকাটি সম্পর্কে অবগত নন। তাই প্রত্যেক পর্যটককে আমরা গাইড নিতে উৎসাহিত করি। তবে গাইড নেওয়াটা বাধ্যতামূলক না হওয়ায় কোনো পর্যটককে গাইড ছাড়া প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া যায় না। পর্যটকরা অসতর্ক থাকার ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে তিনি জানান। বন বিভাগের জোরারগঞ্জ বিট কর্মকর্তা একরামুল হক বলেন, পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মেলখুম ট্রেইল গত বছর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এরপরও পর্যটকরা বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে ভেতরে প্রবেশ করেন। কোনোভাবে পর্যটক প্রবেশ বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে তিনি জানান । পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বারৈয়াঢালা রেঞ্জ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, পর্যটকদের টিকিট দেওয়ার সময় বিপজ্জনক স্থানগুলোতে না যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। পর্যটকরা সচেতন না হলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে না। তিনি আরও বলেন, বৃষ্টিপাতের সময় ও বৃষ্টির পরপরই ঝরনা এলাকায় না যাওয়া উত্তম। এ সময় পাথরগুলো পিচ্ছিল থাকে। সাঁতার জানা না থাকলে ঝরনার কোমর পানিতে নামা ও ওপরে উঠা নিষেধ। মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহফুজা জেরিন বলেন, ইজারাশর্তে নিরাপত্তার মৌলিক বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা গেলে প্রাণহানি অনেকটাই কমে আসবে। পর্যটকদেরও নিজেদের সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |