|
সেফটিপিনের জনক ওয়াল্টার হান্টের বিচিত্র আবিষ্কার
নতুন সময় ডেস্ক
|
![]() সেফটিপিনের জনক ওয়াল্টার হান্টের বিচিত্র আবিষ্কার বানানো শেষে জিনিসটার নাম দিলেন ড্রেস পিন। তিনি সাধারণত এরকম চমকপ্রদ দরকারী জিনিসপত্র উদ্ভাবনে বেশ দক্ষ ছিলেন। আগেও বেশ কিছু জিনিস তিনি বানিয়েছেন। সেগুলো নিজের নামে পেটেন্ট করিয়েছেন। ভাবলেন এটারও পেটেন্ট করিয়ে রাখা যায়। তিনি দেরি না করে নির্ধারিত দফতরে গিয়ে জিনিসটার পেটেন্ট করালেন। তাঁর পেটেন্ট কিনে নিল জর্জ ডব্লিউ. ব্লিস নামের এক ব্যবসায়ী। বিনিময়ে তিনি পেলেন ৪০০ ডলারের মোটা অংক। এই অতিপ্রাপ্তিতে তিনি খুব আনন্দিত হয়ে বন্ধুর ১৫ ডলারের ধার শোধ করে বাড়ি ফিরে এলেন বাকি ৩৮৫ ডলার নিয়ে। কিন্তু বেচারা জানতেন না তাঁর এই উদ্ভাবন কত কার্যকরী একটা জিনিস। কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর এই আবিষ্কারের পণ্য বিক্রি করে ওই কোম্পানি প্রচুর অর্থ কামাই করতে শুরু করেছে। তখন তাঁর কিছু করার ছিল না। সেই দরিদ্র ভদ্রলোকের নাম ওয়াল্টার হান্ট। আমেরিকান ইতিহাসে বিখ্যাত আবিষ্কারকদের তালিকায় থমাস এডিসন, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল বা হেনরি ফোর্ডের মতো বিখ্যাত লোকদের নাম থাকলেও ওয়াল্টার হান্টের নাম নেই। কারণ তিনি তুচ্ছ জিনিসপাতির কাজকারবার করতেন। অথচ তাঁর ছোট ছোট আবিষ্কারগুলো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবন বদলে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন একজন সাদাসিধা মেকানিক। তাঁর সহজাত কৌতূহল ও যন্ত্রপাতির প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল জন্মগত। তিনি অসাধারণ সব দরকারি জিনিসের উদ্ভাবক ছিলেন। সেফটি পিন তার মধ্যে একটি। ওয়াল্টার হান্টের জন্ম ১৭৯৬ সালের ২৯ জুলাই নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের লোভিল অঞ্চলে। শেরম্যান হান্টের তেরোটি সন্তানের মধ্যে ওয়াল্টার ছিলেন প্রথম। গ্রামের একটি এক কক্ষের স্কুলঘরে তাঁর শৈশবের শিক্ষা শুরু হয়। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ বেশিদিন পাওয়ার সুযোগ হয়নি তাঁর। অল্প বয়সেই তিনি স্কুল ছেড়ে দেন। তাঁর প্রথম পেশা ছিল বাড়ি তৈরির রাজমিস্ত্রী। শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করে লোভিলে শহরে চলে যান। ১৮১৪ সালে তিনি পলি লাউক্স নামের এক তরুণীকে বিয়ে করেন। তারপর তিনি যখন স্থানীয় ফ্ল্যাক্স মিলে কাজ শুরু করেন তখন তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ফ্ল্যাক্স বা শণ থেকে সুতা তৈরির এই প্রক্রিয়া তাঁর মনকে যন্ত্রপাতির জটিলতার দিকে নিয়ে যায়। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি শণ ঘোরানোর একটি মেশিন তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। যে কোনো কাজে সমস্যা দেখলে তিনি সেটি সমাধানের একটা যান্ত্রিক উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন। ১৮২৬ সালের দিকে তিনি নিউ ইয়র্ক শহরে চলে আসেন। এই শহর তখন আমেরিকান শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু। হান্ট মূলত তাঁর একটি আবিষ্কারের জন্য অর্থ জোগাড় করতে শহরে গিয়েছিলেন। নিউ ইয়র্কে এসে তিনি একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দেখলেন চোখের সামনে। একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি একটি বাচ্চা ছেলেকে চাপা দেবার ঘটনাটা তার ভেতরে নাড়া দিল। তাঁর মনে হলো, এই ধরনের যানবাহনের জন্য একটি সতর্ক সংকেত থাকা কতটা জরুরি। ![]() সেফটিপিনের জনক ওয়াল্টার হান্টের বিচিত্র আবিষ্কার মাত্র এক বছরের মধ্যে তিনি একটি যান্ত্রিক ঘণ্টা উদ্ভাবন করলেন। ওই ঘণ্টা পা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ওটার নাম দিলেন স্ট্রিটকার গং। তারপর তিনি রিয়েল এস্টেটের জগতে কাজ শুরু করেন। তবু তাঁর মনটা পড়ে থাকতো উদ্ভাবনের জগতে। ১৮২৭ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে তিনি একের পর এক নানা ধরণের কার্যকর ব্যবহারিক জিনিসপত্র তৈরি করতে লাগলেন। যেমন—কয়লা পোড়ানোর স্টোভের উন্নতি করা, ঘরে ছুরি ধার দেওয়ার যন্ত্র এবং রেস্তোরাঁর জন্য বাষ্প টেবিলের সরঞ্জাম। ওয়াল্টার হান্টের সবচেয়ে পরিচিত এবং সবচেয়ে সাধারণ আবিষ্কারটি ছিল সেফটি পিন। হান্টের স্প্রিং ও সুরক্ষা ক্যাপসহ ডিজাইনটিই ছিল আধুনিক ও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত। হান্ট পিনটির নাম দিয়েছিলেন 'ড্রেস পিন'। পরে ওটার নাম হয়ে উঠেছিল সেফটি পিন। ১৮৪৯ সালের ১০ এপ্রিল তিনি এই আবিষ্কারের পেটেন্ট করান। তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতা ছিল অসাধারণ, কিন্তু ব্যবসা করার বুদ্ধি বা আগ্রহ তাঁর ছিল না বললেই চলে। ফলে ওই কোম্পানি এটি বিক্রি করে প্রচুর ডলার আয় করলেও তিনি লাভজনক আবিষ্কার থেকে আর একটি পয়সাও পাননি। সেফটি পিন ছাড়াও হান্টের আরও একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার রয়েছে, যা আধুনিক শিল্প এবং গৃহস্থালি জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। তিনি আধুনিক সেলাই মেশিনের জনক ছিলেন। ১৮৩৩ থেকে ১৮৩৪ সালের মধ্যে নিউ ইয়র্ক সিটির অ্যামোস স্ট্রিটে নিজের দোকানে ওয়াল্টার হান্ট এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেন, যেটাকে অনেকেই প্রথম কার্যকরী সেলাই মেশিন বলে মনে করেন। তাঁর মেশিনের নকশা ছিল অত্যন্ত আধুনিক। তিনি প্রথম আবিষ্কার করেন লকস্টিচ সেলাই প্রক্রিয়া। এই সেলাইতে দুটি সুতা ব্যবহার করা হয়: একটি সুতা আসে চোখ-বিশিষ্ট সুঁই থেকে, ওটা কাপড় ভেদ করে একটি লুপ বা ফাঁস তৈরি করে এবং আরেকটি সুতা শাটল থেকে এসে সেই লুপটিকে লক করে বা আটকে দেয়। এই লকস্টিচ সেলাই মানুষের হাতের সেলাইয়ের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত ছিল। এই নকশাটিই পরবর্তীকালে সেলাই মেশিনের শিল্প মানদণ্ড হয়ে ওঠে। এই আবিষ্কারটি ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কিন্তু ঠিক এই পর্যায়েই হান্ট একটা মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, এই সেলাই মেশিন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হলে হাতে সেলাই করে জীবিকা নির্বাহকারী হাজার হাজার পোশাককর্মী ও দর্জি বেকার হয়ে যাবে। তার এই আবিষ্কার গরিব মানুষদের ক্ষতি করবে এটা তিনি মানতে পারেননি। ফলে তিনি ব্যক্তিগত বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি মেশিনটির পেটেন্ট করবেন না বা এটি বাজারে আনবেন না। হান্টের এই নৈতিকতার দাম দিতে হয় তাঁকে। প্রায় এক দশক পরে, ১৮৪৬ সালে, ইলিয়াস হাউ তাঁর অনুকরণে একই ধরনের নকশার (চোখ-বিশিষ্ট সুঁই এবং লকস্টিচ) পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন এবং পেয়েও যান। এর কিছুদিন পরই আইজ্যাক সিঙ্গার ইলিয়াস হাউয়ের নকশার আরো উন্নতি ঘটিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সেলাই মেশিন তৈরি শুরু করেন। ১৮৫০-এর দশকে যখন সেলাই মেশিনের বাজার রমরমা, হান্ট তখন তাঁর পূর্বের আবিষ্কারের দাবি নিয়ে আইনি লড়াই শুরু করেন। দীর্ঘ মামলা চলার পর, ১৮৫৪ সালে আদালত স্বীকার করে যে সেলাই মেশিনের লকস্টিচ প্রক্রিয়া এবং চোখ-বিশিষ্ট সুঁই-এর আসল উদ্ভাবক ওয়াল্টার হান্ট। কিন্তু যেহেতু তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর ডিজাইনটি ত্যাগ করেছিলেন এবং সেটা তিনি পাবলিকলি প্রকাশও করেননি, তাই পেটেন্ট অধিকার ইলিয়াস হাউ-এর কাছেই থেকে যায়। ১৮৫৮ সালে, আইজ্যাক সিঙ্গার পেটেন্ট সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে ওয়াল্টার হান্টকে তাঁর ডিজাইনের জন্য ৫০,০০০ ডলার দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, হান্ট ১৮৫৯ সালে মারা যান এবং সেই টাকা তাঁর আর পাওয়া হয়নি। আমেরিকায় আধুনিক শিল্প বিপ্লবের এক বিশাল স্তম্ভ তৈরি হলেও ওয়াল্টার হান্টের নাম তার নিচে চাপা পড়ে গেল। ওয়াল্টার হান্টের আবিষ্কারের তালিকাটি দেখলে অবাক হতে হয়। তিনি সারাক্ষণই নানান আবিষ্কারের চিন্তায় মশগুল থাকতেন। তাঁর পুরো জীবনে তিনি অন্তত দুই ডজনেরও বেশি পেটেন্ট অর্জন করেছিলেন, এবং আরও বহু জিনিস আবিষ্কার করেছিলেন যা তিনি পেটেন্ট করার প্রয়োজন মনে করেননি। তাঁর আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার আছে—ভলুশন রিপিটিং রাইফেল: হান্ট প্রথম একটি টিউবুলার ম্যাগাজিন এবং লিভার অ্যাকশন ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুলি ভরা যায় এমন একটি রাইফেলের মডেল তৈরি করেন। এই রাইফেলের জন্য তিনি 'রকেট বল' নামে এক বিশেষ ধরনের কার্টিজ তৈরি করেছিলেন। তাঁর এই নকশাটিই পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত উইনচেস্টার রাইফেলের জন্ম দেয়। ফাউন্টেন পেন: তিনি একটি কলম তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে একটি কালির আধার ছিল। ওটাই হলো আজকের ফাউন্টেন পেনের প্রাথমিক রূপ। পেপার কলার: ১৮৫৪ সালে তিনি ডিসপোজেবল বা একবার ব্যবহারযোগ্য কাগজের কলার আবিষ্কার করেন। আমরা যে শার্টের কলার ব্যবহার করি ওটাও তাঁরই অবদান। তাঁর অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যে আছে—আইস প্লাউ, নখ তৈরির মেশিন, রিভেট তৈরির মেশিন, সাইকেল ফ্রেম এবং সার্কাসের শিল্পীদের জন্য সাকশন সু ইত্যাদি। ওয়াল্টার হান্ট নিঃসন্দেহে একজন দুর্দান্ত উদ্ভাবক ছিলেন, কিন্তু ব্যবসায়ী হিসেবে মোটেও ভালো ছিলেন না। তিনি অর্থের পেছনে ছোটেননি, বরং আবিষ্কারের চ্যালেঞ্জ ও আনন্দই তাঁকে পরিচালিত করত। ![]() সেফটিপিনের জনক ওয়াল্টার হান্টের বিচিত্র আবিষ্কার তাঁর মধ্যে ব্যবসায়িক বুদ্ধির ঘাটতি ছিল। তিনি নগদ অর্থের প্রয়োজনে তাঁর পেটেন্টগুলো দ্রুততার সাথে কম দামে বেচে দিতেন। তাঁর আবিষ্কারের আইনি প্রক্রিয়ার জন্য ড্রাফটসম্যানের টাকা শোধ করার জন্য তিনি বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। সেই টাকা শোধ করতে গিয়েই তিনি সেফটি পিনের স্বত্ব ৪০০ ডলারে বিক্রি করেন। এভাবে তাঁর জীবনের অনেক আবিষ্কারের ফল অন্য মানুষ ভোগ করেছে। তাঁর মেয়ে পরে বলেছিলেন, তাঁর বাবা 'সবসময় কিছু না কিছু আবিষ্কার করতেন', কিন্তু লাভ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিলেন না। তাঁর মূল অনুপ্রেরণা ছিল, যেকোনো সমস্যাকে সহজ করার দিকে। দৈনন্দিন জীবনকে যেন আরও সুবিধাজনক এবং নিরাপদ করে তোলা যায় শুধু ওই দিকেই মনোযোগী ছিলেন তিনি। আর্থিক বিষয় নিয়ে তেমন সচেতন ছিলেন না। সে কারণে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলিতেও তিনি ঋণগ্রস্ত অবস্থায় অভাব অনটন মাথায় নিয়ে কাটিয়েছিলেন। ১৮৫৯ সালের ৮ জুন অখ্যাত মানুষ হিসেবে নিউ ইয়র্কে মারা যান হান্ট। তাঁকে ব্রুকলিনের গ্রিনউড সেমিট্রিতে সমাধিস্থ করা হয়। বিশ শতকে আসার পর মানুষ আস্তে আস্তে তাঁর সম্পর্কে জানতে শুরু করে। তাঁর অবদান নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। তাঁকে আমেরিকান উদ্ভাবনী ইতিহাসের অন্যতম এক ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক বিলম্বে হলেও তাঁকে স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ২০০৬ সালে তাঁর নামটা ন্যাশনাল ইনভেন্টরস হল অফ ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওটাই ছিল তাঁর সকল চমকপ্রদ কীর্তির মরণোত্তর সান্ত্বনা।
|
| পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |
