সম্প্রতি চীনের কাছে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। চীনের ঋণকে যেখানে প্রায়ই ফাঁদ বলে উল্লেখ করা হয়, সেখানে দেশের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে এ ধরনের ঋণ গ্রহণ নিয়ে নানা মহলে হচ্ছে বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন, চীন থেকে ৫০০ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। প্রাথমিকভাবে ঋণ নিয়ে কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
৫০০ কোটি ডলারের ঋণ নেয়া হবে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে এবং এই ঋণের টাকা রিজার্ভের চাপ এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি কমাতে ব্যবহার করা হবে বলে জানান গভর্নর।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন পাওয়ার পর এবার চীনের ঋণের দিকে ঝোঁকা বাংলাদেশের জন্য কতটুকু বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত হবে; সে প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা ব্যবস্থাপক মাহফুজ কবির সময় সংবাদকে বলেন, এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে করে ঋণের এই টাকা খুব দরকার। তবে ইউয়ানে না দিয়ে ঋণের টাকা ডলারে দিলে দেশের জন্য বেশি সুবিধাজনক হতো।
চীনের ঋণ ফাঁদ কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ কবির বলেন, এই ধরনের কথার এত বেশি প্রচলন হয়েছে যে অনেকেই মনে করে, চীন থেকে ঋণ নিলেই বাংলাদেশ ফাঁদে পড়বে। চীনের থেকে ঋণ নেয়ার বড় সুবিধা ওরা প্রায় শর্তহীনভাবে ঋণ দেয়। আর রিজার্ভের জন্য এই ঋণ শতভাগ নিরাপদ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। তবে ঋণ ছাড় করতে চীন অনেক দেরি করে। রিজার্ভে চাপ কমাতে হলে এই ঋণ ছাড় করতে হবে দ্রুত।
১৯৭৪-৭৫ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে আসছে চীন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেয়া ৩২০ কোটি ডলারেরও বেশি ঋণের সিংহভাগ ছাড় হয়েছে বিগত এক দশকে। বাংলাদেশের রিজার্ভে সক্ষমতা বাড়াতে হলে এই বছরের মধ্যেই ঋণ ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে বলে অভিমত অর্থনীতিবিদদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঋণের অঙ্ক ৫০০ কোটি ডলার এমন না, বাংলাদেশের লক্ষ্য থাকবে ৫০০ কোটি ডলারের ওপরে ঋণ নেয়া। চীনের সঙ্গে আলোচনার ওপর নির্ভর করছে ঋণের পরিমাণ, হতে পারে এটি ৭০০ কোটি বা ১ হাজার কোটি ডলার।
এভাবে দেদারসে ঋণ নিলে পরিশোধের ভার কতটা সহ্য করতে পারবে বাংলাদেশ- এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ কবির বলেন, যারা চীন থেকে ঋণ নিয়ে বিপদে পড়েছেন, তাদের সিংহভাগ নিজেদের ঋণ ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণে বিপদে পড়েছেন। বাংলাদেশ যদি ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারে তাহলে ঋণের ফাঁদের শঙ্কা অনেকটাই কেটে যাবে।
শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার দেশগুলো নিজদের ঋণ অব্যস্থাপনার কারণে বিপদে পড়েছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আফ্রিকার দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে চীন যে চুক্তি করেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে এমন বিধ্বংসী চুক্তিতে চীন যাবে না। আপাতত চীন থেকে ঋণ নিয়ে রিজার্ভ এবং ডলার সংকট প্রশমন করা সঠিক সিদ্ধান্ত।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের সঙ্গে তুলনা করলে ৭ বছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। যেখানে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার; তা ২০২৩ সালে এসে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট ঘাটতি মেটাতে এসব বিদেশি ঋণের বোঝা দিনকে দিন অর্থনীতিতে চাপ বাড়াচ্ছে। এরমধ্যে বাড়তি ঋণের চাপ আরও বাড়াবে। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ঋণ নেয়া ছাড়া বাংলাদেশের হাতে বিকল্প কোনো পথ নেই বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সময় সংবাদকে বলেন, চীন বাংলাদেশকে ঋণ দিলে সেটি ইউয়ানে অর্থাৎ নিজস্ব মুদ্রায় দেবে। এতে করে উল্টো লাভ হবে চীনের। ইউয়ানে বাংলাদেশ চীনের পণ্য কিনে চীনের থেকে নেয়া ঋণে দেনা পরিশোধ করবে। মাঝখান থেকে ২০-২৫ বছরের জন্য বড় একটি ঋণের বোঝা এসে চাপবে বাংলাদেশের ঘাড়ে।
বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানোর প্রসঙ্গ টেনে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, রাজস্ব আদায় না বাড়িয়ে দিনকে দিন বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে থাকলে সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান আসবে না। আবার রাজস্ব বাড়ানোর নামে জনগণের ওপর ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দিলে রাজস্ব কর্মকর্তাদের পকেট ভরবে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, বাংলাদেশ নভেম্বর ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে। ফলে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে দেশের উন্নয়ন হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রেক্ষাপটে, দেশের চলমান উন্নয়ন ধরে রাখতে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট শাখাকে স্বয়ংক্রিয় ও ডিজিটালাইজড করে করদাতা, ব্যবসায়ী ও নাগরিকদের নির্বিঘ্নে সেবা দেয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
অর্থনীতি সম্পর্ক বিভাগের তথ্যানুসারে, বর্তমান বিদেশি ঋণের অর্ধেকেরও বেশির যোগানদাতা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। এর বাইরে জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারত থেকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে।
বর্তমানে দেশে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে ১৫-১৭ শতাংশের মধ্যে থাকলেও, পরবর্তীতে এটি বাড়তে শুরু করলে, ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।