ঐতিহ্য হারাতে বসেছে মাছ ধরার চাঁই
নতুন সময় প্রতিনিধি
|
মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার রমজানবেগ এলাকায় ‘চাঁই’বুননে হাঁক ডাক ছিল বেশ। অবৈধ চায়না জালের অবাধ বিস্তারে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বাঁশ দিয়ে হাতে তৈরি মাছ ধরার চাঁই। এক সময় প্রতিটি বাড়ির উঠানে উঠানে দেখা যেতো চাই বুনন কাজে ব্যস্ত কারিগররা। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি এলাকার শতাধিক পরিবার চাঁই বুনে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে অবৈধ চায়না জালের অবাধ বিস্তারে তারা এ পেশা ছেড়ে চলে গেছে অন্য পেশায়। বর্তমানে ৩টি পরিবার তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। হাতে গোনা বিশজনের মতো এই পেশায় এখন জড়িত। হাতে তৈরি এ ‘চাঁই’এর চাহিদা কমে যাওয়ায় তারাও ছাড়বেন এ পেশা। এ কারণে এ এলাকায় ঐতিহ্য বিলীন হতে চলছে বাঁশ দিয়ে হাতে তৈরি মাছ ধরার চাঁই। আসছে বর্ষা মৌসুম। দেশীয় মাছের স্বাদ নিতে গ্রামের খালে এবং উন্মুক্ত জলাশয়ে চাঁই পেতে মাছ ধরে গ্রামের মৎস্যজীবী, হতদরিদ্রসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। তবে অবৈধ চায়না জালের অবাধ বিস্তারে হতাশ চাঁই কারিগররা। এক সময় যে গ্রামে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই দেখা যেতো চাঁই বুননে ব্যস্ত কারিগররা। শুধু ঘরের কর্তা ব্যক্তি নয়, এ কাজে সহযোগিতা করতো স্ত্রী, পুত্র, ভাই, বোন, বৃদ্ধ মা ও বাবা। ধাপে ধাপে চাঁই তৈরির কাজ শেষে সেগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখতেন। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে পরিবারের সবাই হাত লাগিয়েছেন এসব কাজে। কেউ বাড়ির আঙিনায় কিংবা ঘরের বারান্দায়, কেউবা বাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গায় বসে আপন মনে বাঁশ কাটতেন, কেউ সলা তুলতেন। কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে সেই দিন। এক একটি চাইঁ বুনতে আকার ভেদে খরচ হয় ৩ শ থেকে ৪ শ টাকা, বিক্রি হয় ৬ শ টাকা। এদিকে ধীরে ধীরে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়ায় জড়িতরা চলে গেছেন অন্য পেশায়। যারা জড়িত রয়েছেন সরকারি সহযোগিতার দাবি তাদের। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। সরেজমিন রমজান বেগ এলাকায় দেখা যায়, তিনটি বাড়ির আঙিনায় ফাঁকা জায়গায় বসে আপন মনে বাঁশ কাটছেন, কেউ সলা তুলছেন। ধাপে ধাপে চাঁই তৈরির কাজ শেষে সেগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখছেন। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে পরিবারের সবাই হাত লাগিয়েছেন এসব কাজে। রমজান বেগ এলাকার চাঁই তৈরির কারিগর মো. সবুজ বলেন, ‘এখন আর আমাগো সেই দিন নেই। চায়না চাঁই আমাগো শেষ কইরা দিছে। আমরা এই সময়ে যেই ব্যস্ত থাকতাম। আর করমু না এই ব্যবসা, ছাইড়া দিমু।’ আক্ষেপ নিয়ে তিনি আরো বলেন, চায়না চাঁই সরকার আর বন্ধ করতে পারলো না। এক সময় বিভিন্ন এনজিও ও ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে, আবারোকেউ কেউ বড় ব্যবসায়ীদের কাছ খেকে দাদন নিয়ে বাঁশ কিনে চাঁই তৈরি করতেন। এসব চাঁই বিক্রি করে চলতো গ্রামের ৬০ থেকে ৭০ টি পরিবার। চাই বানানোর কারিগর আসমা বেগম বলেন, চায়ের কয়েকটি অংশ সুতা দিয়ে জোড়া লাগানো। এই কাজের জন্য আমি ২৫ টাকা পাই। আগে তো অনেক কাজ ছিল এখন কাজের চাপ কমে গেছে। চাই বানানোর কারিগর রাধা নাথ বলেন, এখন এই পেশায় যত জন আমরা জড়িত আছি সাত দিনে একশ’র মতো চাই বানাতে পারি। একেকজনের কাছে একেক ধরনের কেউ বাঁশ থেকে সলা বের করা। কেউ আবার কেটে সাইজ মতো করে দেওয়া। আরেকজনের কাজ বিভিন্ন অংশ তৈরি সুতো দিয়ে জোড়া লাগিয়ে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া। চাঁই বুননের কারিগর নারায়ণ চন্দ্র সরকার বলেন, প্রতি বছর মাঘ মাসে আকারভেদে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় প্রতিটি বাঁশ কেনেন। এরপর বাঁশ সাইজ মতো কেটে পানিতে ভিজিয়ে রেখে শলা তৈরি করতে হয়। সপ্তাহের তিন দিন বাঁশ থেকে শলা তৈরি করেন এবং বাকি চার দিন দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। শরীয়তপুর থেকে চাঁই কিনতে আফাজুদ্দিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, মুন্সীগঞ্জের এ এলাকার চাঁই কিনে নিয়ে নানা জায়গায় বিক্রি করে সংসার ও ছেলে মেয়ের লেখাপড়া খরচ চালাই। এখানে একটা চাঁই কিনতে লাগে ৬ শ টাকা। চাঁইয়ের সঙ্গে গড়াও লাগে, নইলে মাছ চাঁইয়ে যাইবো কেমনে। একটা গড়ার দাম ৪ শ টাকা, মোট ১ হাজার টাকায় হয়ে যায়। যারা মাছ ধরে আমি একটু বাড়িয়ে তাদের কাছে বিক্রি করি। চাঁদপুর থেকে চাই কিনতে আসা ইসমাইল সরকার জানান, আগে বর্ষা আসার আগে মাসে কয়েকবার আসতে হতো। কিন্তু এখন চায়না দুয়ারী আসার কারণে চায়ের বেচাকেনা কমে গেছে চাহিদা ও কমে গেছে। যার জন্য আমাদেরও কম আসতে হয়। মুন্সীগঞ্জ বিসিকের উপ ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল্লাহ বলেন, বর্তমানে বাজারে অবৈধ চায়না ফিশিং নেট চলে আসায় রমজান বেগ এলাকার মাছ ধরার চাঁই তৈরির শতাধিক কারিগর বিপাকে পড়েছেন। বর্তমানে তিনটি পরিবার তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। প্রশাসনসহ সবাই মিলে এই অবৈধ নেট বন্ধে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু চলছে। এ জন্য সব ধরনের আইনগত ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। চাঁই বুননের এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার করা হবে।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |