একজন লীলাবতী
ডাক্তার সাবরিনা চৌধুরী
|
![]() একজন লীলাবতী লীলাবতীর বয়স যখন মাত্র সাত বছর তখনি সে টের পায় সে আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়! আস্তে আস্তে তার পরিবারও এটা উপলব্ধি করে ! ছয় ভাই আর এক বোনের সংসারে চরম বৈষম্যের শিকার হয় সে ! আপন ভাইরা কথায় কথায় তার উপর অত্যাচার করে ! যেন এই লৈঙ্গিক অসম্পূর্ণতা তারই অপরাধ! একদিন অতিষ্ঠ হয়ে ঘর ছেড়ে যায় লীলাবতী! গুরুমাতার আশ্রয়ে তার নতুন জীবন শুরু হয় ! তৃতীয় লিংগের একজন গুরু থাকেন যার তত্ত্বাবধানে লীলাবতীর মতো জনা বিশেক মানুষ থাকে ! নাচ, গান, হাতে তালি দিয়ে টাকা আবদার করে আদায় করা শিখতে লাগলো সে! কখনও চলন্ত বাসে, কখনও নবজাতকের জন্মের পর গৃহ কর্তার কাছে, কখনও দোকানে , কখনও অনুষ্ঠানে চলতো তাঁদের “কালেকশন”! কখনও নগদ টাকা আবার কখনও নবান্নের মৌসুমে চাল! দলের সাথে লীলাবতী ঘুরতে লাগলো দেশের নানা প্রান্ত-সুনামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা! কখনও উপার্জনের তাগিদে এমন কিছু করতে হতো যা করতে মন সায় দিতো না তার ! এক যুগ পর কেন যেন হাঁফিয়ে উঠলো সে! পরিচিত এক মানুষকে সুপারিশ করে আমার বাসায় কাজ নিলো- নতুন করে বাঁচার তাগিদে! একটি ভদ্র চাকরির সন্ধানে! আমি তাকে বোনের মতোই আদরে শাসনে রেখেছি! সেও পুরো উজাড় করেই আমাদের ভালবেসেছে! ঘরের কাজও নিজ থেকেই দক্ষতার সাথে করেছে- ভরসা করতাম তার উপর চোখ বনধ করেই! তিন মাসের মাথায় তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা দেখলাম! আম্মার সাথে আলাপ করলাম ! আম্মা বললেন, যে উড়ালপংখী হয়ে এক যুগ মুক্ত জীবন কাটিয়েছে তাকে সোনার খাঁচায় বাঁধা যায়না! আমি জীবনে কোন সম্পর্ককে বাঁধতে চাইনি! লীলাবতীকেও আটকালাম না! বললাম, যদি গুরুমাতা আর তার দলের জন্য প্রাণ কাঁদে তাহলে যাও! সে ফিরে গেল! সেই পুরাতন পেশায়! বন্যেরা বনে সুন্দর- এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম! হঠাৎ তার ফোন ! ধরব না - ধরব না ভেবেও কেন যেন ধরলাম! রোযার মাস - কিছু হয়তো দরকার ওর! লীলা যেজন্য কল করেছে সেটা শুনে মাথায় বাজ পরলো! জানালো, ফেসবুক আর টিকটকে ওর আর আমার ভিডিও দেখে একজন ওর সন্ধান পেয়ে ওকে বারবার কল করছে! লীলাবতীকে সে প্রস্তাব দিয়েছে - লীলা যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও আপলোড করে যে আমি তাকে নির্যাতন করে বের করে দিয়েছি অথবা আমার খুব ঘরোয়া কোন ভিডিও ভাইরাল করে দেয় তবে ঐ ব্যক্তি তাকে মোটা অংকের টাকা দিবে! আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না! তখন লীলাবতী আমাকে কল রেকর্ড শোনালো- সেই ব্যক্তির কন্ঠ স্বর আমি ভালোমতোই চিনি! আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! না, এজন্য না যে কেউ ষড়যন্ত্র করছে! কারণ মানুষের শত্রুতার শিকার আমি হয়েছি, হচ্ছি, আল্লাহ মাফ করুন হয়তো ভবিষ্যতেও হবো! আমি অসম্ভব রকমের হতভম্ব এজন্য হলাম যে, যেই অপূর্ণ মানুষটা হাত তালি দিয়ে ট্রাফিক সিগন্যালে টাকা চেয়ে বেড়ায়, সামান্য বিশ টাকার জন্য যে হাঁটুর উপর পরনের কাপড় তুলে ফেলার ভংগি করে বলে, “দিবি না দেখাব ?”- সেই মানুষটা শুধুমাত্র বিশ্বস্ততার কারনে হাসিমুখে লাখ টাকার প্রলোভন তুচ্ছ করে দিলো! এই সমাজ লীলাবতীদের হিজড়া বলে গালি দেয়, অপয়া, অলক্ষুণে আর অপাংক্তেয় মনে করে ! সমাজের চোখে ওদের মর্যাদা নেই কিন্তু তারা জানে, কিভাবে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে হয ! লীলাবতীদের সাথে কেউ সম্পর্ক করেনা কিন্তু ওরা সম্পর্কেকে সন্মান দিতে সব প্রলোভনকে বৃদ্ধাংগুলি দেখায় ! সত্যি ওরা দেখাতে জানে !!!
|
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |