পর পর দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী না থাকার প্রস্তাব এলো কীভাবে?
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Wednesday, 4 September, 2024, 9:11 PM
পর পর দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী না থাকার প্রস্তাব এলো কীভাবে?
একজন ব্যক্তি যেন দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, এই আলোচনা এখন রাজনীতির ভেতরে-বাইরে। বিগত কয়েক দিন ধরে এই আলোচনাটি এসেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। প্রস্তাবকরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট কায়দা যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আবারও জেঁকে না বসে, সে কারণেই এই নিয়মের মধ্যে যেতে হবে।
৫ আগস্ট সেনাআশ্রিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে বিজয়ী শক্তি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সমাজের নানা পক্ষের বিশিষ্টজনেরা ‘পর পর দুই মেয়াদে যেন কেউ প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন’ সে বক্তব্যটিকে সামনে এনেছেন। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রকে নিরুৎসাহিত করতে এই প্রস্তাবটি এলে প্রথমে এসেছে কোন পক্ষ থেকে? কোন রাজনৈতিক নেতা প্রথম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ‘পর পর দুই মেয়াদে কোনও ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না’।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ শীর্ষক ২৭ দফায় এই বিষয়টি উল্লেখ করেন। ৫ নম্বর দফায় বলা হয়, ‘পর পর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না’। এই রূপরেখার ৪ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে।’
২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপস্থাপিত ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’, ওয়েস্টিনের সেই অনুষ্ঠানে রূপরেখা পাঠ করছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপস্থাপিত ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’, ওয়েস্টিনের সেই অনুষ্ঠানে রূপরেখা পাঠ করছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন
রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে ভার্চুয়ালি তারেক রহমানের ওই রূপরেখা সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনার পর বিস্তারিত তুলে ধরেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ওই রূপরেখা ঘোষণা ও ভবিষ্যৎ শাসন কাঠামোর সম্ভাব্য প্রতিশ্রুতি দিতে বিএনপির অবস্থান তৈরিতে বাম, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের আলোচনা-ঐক্যের প্রভাব ছিল। অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন বিরোধী দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতারা।
ওই অনুষ্ঠানের পর আলাপে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছিলেন, ‘আমরা মনে করি এই রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতন্ত্র রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পরিবর্তন আসবে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন চলে গেছে তারা রাষ্ট্রে কী পরিবর্তন আনবে। চলমান জমিদারি চলবে, নাকি জনগণের পক্ষে রূপান্তরের দিকে যাবে।’
রূপরেখায় তারেক রহমান উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঘোষিত ১৯ দফা ও ২০১৭ সালে ঘোষিত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০২৩’ আলোকে রূপরেখাটি প্রস্তুত করা হয়েছে। হোটেল ওয়েস্টিনে ঘোষিত খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০২৩’ মূলত বিএনপির বিস্তারিত পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতির ঘোষণাপত্র। বিএনপি চেয়ারপারসনও তার প্রস্তাবিত ২৫৬ দফা সংবলিত রূপরেখার ৫ নম্বর দফায় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার কথা বলেন।
২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে খালেদা জিয়া ‘ভিশন-২০৩০’ উপস্থাপন করলেও এর রাজনৈতিক ঘোষণা মূলত আসে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনে খালেদা জিয়া জানান, ক্ষমতায় এলে তার দল জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করবে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা নিরসনকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্র্রের এককেন্দ্রিক ক্ষমতা দূর করতে সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বিএনপি।’
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর নয়া পল্টনে পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশে ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। তৎকালীন সরকার ও প্রশাসন নয়া পল্টনে সমাবেশ করতে বাধা দেয়। ৭ ডিসেম্বর নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সমাবেশের একদিন আগে মধ্যরাতে গ্রেফতার হন মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাসসহ আরও কয়েকজন সিনিয়র নেতা। নয়া পল্টনে নির্ধারিত সমাবেশটি সেদিন গোপীবাগ মাঠে করেছিল বিএনপি। পরে ১৯ ডিসেম্বর ওয়েস্টিনে বিএনপি এই রূপরেখা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে।
বিএনপির সঙ্গে যুগপতে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোও তখন সম্মিলিতভাবে একটি রূপরেখা ঘোষণার জন্য আলোচনা করে। সেই আলোচনার ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই গুলশানের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা’ ঘোষণা করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই রূপরেখায়ও প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে বিএনপি। ৩১ দফার প্রথম ৪ ও ৫ নম্বর দফায় আরও উল্লেখ করা হয়, ‘পর পর দুই টার্মের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।’
এ বিষয়ে আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘পর পর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, কিংবা ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির বিষয়ে বিএনপিই প্রথম প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। বিএনপিই সবার আগে ভবিষ্যতে যেন ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠা না পায় এবং জনগণের মালিকানার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়, সেই বক্তব্য দিয়েছে, সংগ্রামও করছে।’
বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকালে আমির খসরু বলেন, ‘২০১৭ সালের ১০ মে বেগম খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০-এ স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির কথা। একটি ইনক্লুসিভ সোসাইটি গড়ে তোলার জন্য রেইনবো ন্যাশন্স গড়ে তোলার কথা তিনিই বলেছেন। এই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’য় পর পর দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এই অবস্থান ব্যক্ত করেছেন তারেক রহমান।’
‘সুতরাং, বিভ্রান্তির কোনও সুযোগ নেই। এটা আমাদের প্রোগ্রাম। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে বিএনপি জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আমরা ক্ষমতার জন্য নির্বাচিত হলে এটা বাস্তবায়ন করবো’, বলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
প্রসঙ্গত, বিএনপির ঘোষিত তিনটি রূপরেখায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা, গণভোট প্রবর্তন, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনসহ নানা বিষয়ে প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২৭ দফা ঘোষণা পর ‘রাষ্ট্র মেরামত’ আদৌ সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন তুলেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের ভাষ্য ছিল—‘বিএনপির ২৭ দফা একইমুখে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও রেইনবো ন্যাশনের কথা চরম দ্বৈততা ও দ্বিচারিতার পরিচায়ক।’