মেট্রোরেলে ভ্যাট নয়, বরং সরকারি খাতে অপচয় বন্ধ করুন
চপল বাশার
|
উত্তরা থেকে মতিঝিলে মেট্রোরেলে যাতায়াতকারী যাত্রীদের কপালে এখনই চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেছে। আসছে পয়লা জুলাই থেকে মেট্রোরেলের টিকিটে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তা যদি হয় তাহলে উত্তরা-মতিঝিল রুটে ১০০ টাকার টিকিট হয়ে যাবে ১১৫ টাকা। একইভাবে মেট্রোরেলের সব টিকিটের দাম বেড়ে যাবে। মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রীদের প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এদের কাছ থেকে মেট্রোরেল যদি ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করে, তাহলে নিঃসন্দেহে স্বল্পআয়ের যাত্রীদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ আর কত চাপ সহ্য করবে? গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মেট্রোরেল চালুর পর আগামী জুন মাস পর্যন্ত টিকিটের ওপর যে ভ্যাট মওকুফ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তা আর অব্যাহত রাখতে চায় না এনবিআর। এই সিদ্ধান্ত মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এনবিআর-এর পদস্থ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, তাদের ওপর রাজস্ব আদায়ের চাপ রয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহারের। এসব কারণেই মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট মওকুফ-সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। এনবিআরকে সরকার রাজস্ব আদায় বাড়াতে বলেছে, কারণ সরকারকে বিভিন্ন খাতে খরচ বাড়াতে হবে। মেট্রোরেলের টিকিটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করলে বছরে রাজস্ব আয় কত বাড়বে তা জানা যায়নি। তবে ধারণা করা যায় সেটা বিশাল কিছু হবে না। মেট্রোরেল আছে কেবলমাত্র রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে। সেটা চলে উত্তরা-মতিঝিল-উত্তরা রুটে। এর দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। মোট ১৬টি স্টেশনে মেট্রোরেল থামে, যাত্রী ওঠায়, যাত্রী নামায়। এই রুট কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের কাজ চলছে। পুরো ঢাকা মহানগরী মেট্রোরেল সুবিধার আওতায় আসেনি। মহানগরীর উত্তরাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলের একাংশের মানুষ এই সুবিধা ভোগ করছেন। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলেছেন ক্রমান্বয়ে এই আধুনিক গণপরিবহন অন্যান্য এলাকায় সম্প্রসারিত হবে। মেট্রোরেল এখন যে অবস্থায় আছে, তাতেও বিপুলসংখ্যক নগরবাসী এর সুবিধা ভোগ করছেন। সচিবালয়সহ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার কর্মচারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীসহ নগরীর লাখ লাখ মানুষ মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন। শুক্রবার ব্যতীত সপ্তাহের ছয়দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল করে। বিপুলসংখ্যক নাগরিক মেট্রোরেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। কারণ মানুষ যানজট এড়িয়ে অল্প সময়ে চলাচল করতে পারছেন স্বস্তিতে। বিশ্বের যে কোনো আধুনিক নগরীতে মেট্রোরেল এখন অপরিহার্য গণপরিবহন। মেট্রোরেল নগরবাসীর উপকারে এসেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও ঠিক যে, যাত্রী ভাড়া বা টিকিটের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তা অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি। স্বল্প আয়ের মানুষের আয়ের কথা বিবেচনা করে দাম আরও কম রাখা উচিত ছিল। তবুও জনগণ তা মেনে নিয়েছিলেন স্বস্তিতে যাতায়াত করা যাবে বলে। কিন্তু ভ্যাট আরোপ করে টিকিটের দাম বাড়ানো হলে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর জুলুম করা হবে। স্বস্তিটা আর থাকবে না। এনবিআর-এর মাধ্যমে সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে চান। রাজস্ব আয় বাড়াতে হয় বিভিন্ন সরকারি খাতে বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য। কিন্তু এজন্য জনগণের ওপর কর ও ট্যাক্সের বোঝা বাড়াতে হবে কেন? জনগণ যথেষ্ট কর ও ট্যাক্স দিচ্ছে এবং তা বছর বছর বাড়ানো হয়। দেশের ধনী-দরিদ্র প্রতিটি মানুষই সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক। কিন্তু জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে অর্থের যোগান দিতে হবে, এটা সঠিক নয়। সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। এক্ষেত্রে অপব্যয় বা অপচয়ের অভিযোগ রয়েছে। সরকারি অর্থের অপব্যয় ও অপচয় বন্ধ করা গেলে জনগণের ওপর বাড়তি কর-ট্যাক্স-ভ্যাট আরোপ করার প্রয়োজন হবে না। এ কথা সবাই বলেন যে, বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারাই সবচেয়ে সুবিধাভোগী মানুষ। বিপুল অংকের বেতন ও ভাতা তাদের দেওয়া হয়। তদুপরি গাড়ি কেনার জন্য বিনাসুদে ঋণ, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বড় অংকের ভাতাও পান। এসব কি সরকারি অর্থের অপচয় না? সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ তো এখন সাধারণ ব্যাপার। কারণে-অকারণে তাদের এত বিদেশ ভ্রমণ দৃষ্টিকটু। একবার সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, একদল সরকারি কর্মকর্তা বিদেশে যাবেন ফলের চাষ কীভাবে করা হয় তা দেখতে। আর একবার প্রকাশিত খবরে জানা যায় সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে কোথাও যাবেন মাছের চাষ শিখতে। এসব খবরের সত্যতা অস্বীকার করে সরকারপক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি তখন। সম্ভবত পরিকল্পনা কমিশনে এ ধরনের প্রশিক্ষণ সফরের প্রস্তাব আটকে যায়। কিন্তু এ ধরনের প্রস্তাব করা হয় কীভাবে? সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে উচ্চতর শিক্ষা তথা মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়া হয় বলে শোনা যায়। এজন্য একজনের পেছনে সরকারি টাকা খরচ হয় বিপুল পরিমাণে। বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়া প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা, যিনি চাকরিতে আছেন তার কি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে হবে? এসব তথ্য যদি সঠিক না হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দেবেন। কথা হচ্ছিল, রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য মেট্রোরেলের টিকিটের ওপর ভ্যাট আরোপ প্রসঙ্গে। সরকারের বিভিন্ন খাতে অপব্যয় ও অপচয়ের কথা প্রায়ই শোনা যায়। এসব অনর্থক ব্যয় বা অপচয় কমিয়ে মেট্রোরেলের যাত্রীদের বাড়তি খরচের হাত থেকে রেহাই দেওয়া কি যায় না? অবশ্যই যায়। প্রয়োজন মেট্রোরেলের যাত্রীদের জন্য সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের সহানুভূতি। এজন্য সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ সবাই আশা করছেন। মেট্রোরেলের ভাড়া অপরিবর্তিত রাখা কঠিন কোনো কাজ নয়। যদি সদিচ্ছা থাকে। চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক |
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |