বিশ্বে কেন হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি অনন্য
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
|
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পর বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উত্থান-পতন, পরাশক্তিগুলোর শীতল যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্বমন্দার মধ্যেও দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রেখে ' সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র গত ৫২ বছর ধরে সময়োচিত হিসেবে প্রমাণিত । বঙ্গবন্ধুর শান্তি ও প্রগতির পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেই উন্নয়নের মহিসোপানে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ । সৌহার্দ্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি, আঞ্চলিক শান্তি ও পরাশক্তিগুলোর সাথে সমতার ভারসাম্যের নীতিতে বিশ্ব নেতাদের কাছে এক অনন্য নাম শেখ হাসিনা। মূলত বিশ্বশান্তির দর্শনের আলোকে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার বিকল্প তিনি নিজেই। কোন দেশের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে সেদেশের অভ্যন্তরীণ নীতির সম্প্রসারিত রুপ । এর প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নির্ভর করে দেশটির নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক দক্ষতার উপর। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান থেকে লন্ডন এরপর কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফেরা বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির আভিজাত্য । সেই পররাষ্ট্রনীতির প্রবহমানতা শেখ হাসিনার হাত ধরেই প্রস্ফুটিত। গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ইতিহাসে নজিরবিহীন শেখ হাসিনার বাংলায় ১৭তম ভাষণ তারই সাক্ষ্য বহন করে। শান্তিপূর্ণভাবে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমূদ্রসীমার নিষ্পত্তি, ভারতের সাথে ছিটমহল বিনিময় ও রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতার জন্য মানবিক বিশ্বের প্রধান নেতা শেখ হাসিনা । উন্নয়নশীল একটি দেশ হয়েও সারা বিশ্বের নিকট ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা, টেকসই উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-মাদক নির্মূল , জনগনের ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত এখন বাংলাদেশ। তাই নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, 'কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেবার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের'। শেখ হাসিনা ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট চিন্তা করে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণে সিদ্ধহস্ত । একবিংশ শতাব্দীতে জলবায়ু, যুদ্ধ ও বিশ্বমন্দাসহ নানাবিধ সংকট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর সুদূরপ্রসারী পররাষ্ট্রনীতিরই ফলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ড এখন বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যেভাবে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বকীয়তার জানান দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, বর্তমানে শেখ হাসিনাও বিশ্বমঞ্চে গর্বিত করছেন বাংলাদেশকে। সর্বশেষ জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে শেখ হাসিনা বৈশ্বিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেককে ঐক্যবদ্ধভাবে মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়েছেন। তথাপি, প্রধানমন্ত্রীর সফল কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে ঢাকায় বিমসটেক এর স্থায়ী সচিবালয় স্থাপন, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের বিপক্ষে সমুদ্রসীমা বিজয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ঠিক তেমনিভাবে, শেখ হাসিনা সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে ও মায়ানমারের স্বদিচ্ছায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নবান্ধব সরকার ইতোমধ্যে ১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গায় বিদেশি বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করায় বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রবাহে ভাটা সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ( এফডিআই) দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । অধিকন্তু, দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধির দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি হওয়ায় বিদেশি ব্যবসায়ীরাও আকৃষ্ট হচ্ছে। সেই জন্য শেখ হাসিনার সরকার পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির পাশাপাশি ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। করোনা পরবর্তী যুদ্ধ ও বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক কূটনীতির সফল বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে রপ্তানি আয় প্রায় ৫৫ বিলিয়ন ডলার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৫ সালের ৩.২ বিলিয়ন ডলার থেকে বর্তমানে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের অধিক উন্নিত হয়েছে। এর ফলে একসময়ের তথাকথিত 'তলাবিহীন ঝুড়ি' আজ উন্নয়নের বিস্ময় । তারই স্বীকৃতিস্বরুপ, ২০১৯ সালে জাতিসংঘ অধিবেশনে তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের মডেল’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন । বঙ্গবন্ধুকন্যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উন্নয়নের পরিকল্পনা 'রূপকল্প ২০৪১' ও 'রূপকল্প ২১০০' নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অদম্য বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসায় বিশ্বনেতৃত্ব । ইতোমধ্যে তিনি বিশ্বের শীর্ষ দশ মহান নেতার একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন । তথাপি শান্তিপূর্ণ ইমেজের স্বীকৃতি হিসাবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। শুধু তাই না, বিশ্বব্যাংকের পক্ষপাতদুষ্ট নীতির প্রতি নতি স্বীকার না করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে দ্বিতল পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। ভিশনারি নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিকভাবে অসংখ্য পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ফেলিক্স হোফে বোইনি’ শান্তি পুরস্কার, বিশ্ব ভারতী কর্তৃক ‘দেশিকোত্তম’, ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ২০২১ সালে বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০ নারীর তালিকায় অবস্থান, ‘মাদার তেরেসা’ পদক, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা কর্তৃক ‘সেরেস পদক’, ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক ২০০৯’, ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন । এ ছাড়াও শান্তি বৃক্ষ পদক, এমডিজি ও এসডিজি পুরস্কার, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড, কালচারাল ও গ্লোবাল ডাইভার্সিটি অ্যাওয়ার্ড, ডক্টরস অব হিউম্যান লেটার্স পদকসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা অর্জন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তথাপি দক্ষ নেতৃত্ব ও মানবিকতার জন্য বিশ্বের প্রায় সব খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রীতে ভূষিত হয়েছে তিনি । শুধু বিশ্ব ফোরামে নয়, বিশ্ব গণমাধ্যমেও নানা অপ্রিয় প্রশ্ন ও অমিমাংসিত সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধানে তার সপ্রতিভ উপস্থিতি বাংলাদেশকে গর্বিত করে। এভাবেই কখনো বিশ্বমঞ্চ, কখনো বিশ্ব মিডিয়ায় তুলে ধরছেন অদম্য বাংলাদেশকে। তারই নেতৃত্বে এক সময়ের ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশটি আজ আর্বিভূত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে। ঐতিহাসিক যুগ থেকে মানবতাই ছিলো বাঙ্গালীর প্রধান সম্পদ। কবি চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’, কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের ‘গাহি সাম্যের গান'- এসব লেখায় আমরা সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য পাই। চণ্ডীদাস ও নজরুলের চিন্তা ও বঙ্গবন্ধুর শোষিতের দর্শনতত্ত্ব বাঙালির মনন ও মানসে শতাব্দীর পর শতাব্দী উচ্চারিত হচ্ছে। চন্ডিদাস, নজরুল ও বঙ্গবন্ধুর মত শেখ হাসিনার উক্তিও মানবতাই সবার ঊর্ধ্বে। একটা দেশের উন্নয়নে লিডারশিপ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন মুলুকে জর্জ ওয়াশিংটন ও আব্রাহাম লিংকনের আধুনিক আমেরিকা, নেপোলিয়ন এবং ডি গলের আধুনিক ফ্রান্স, ম্যাগনাকার্টার আধুনিক ব্রিটেন, মাও সে তুং এর চীন, মহাত্মা গান্ধী ও নেহেরুর আধুনিক ভারত সৃষ্টি মত বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। আর মানবিকতায় অনন্য ভূমিকা রাখায় গ্রিক হেরোডেটাস, রোমান সিসেরাস, ব্রিটিশ গিবন, নেলসন ম্যান্ডেলা ও মাদার তেরেসার কাতারের এসে দাড়িয়েছেন শেখ হাসিনা। শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসাবে শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ‘পিস ক্যাম্পেইন’ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন । তারই ফলস্বরূপ, জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী ‘শান্তির সংস্কৃতি’ চালু হয়েছে। সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ বিশ্বশান্তির এই অমোঘ নীতিই শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই সকল বাঁধার পাহাড় ডিঙিয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির রোল মডেল বাংলাদেশ । গত এক দশকে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় নেতৃত্বে অজস্র কূটনৈতিক সাফল্যে রচিত হয়েছে সফলতার মহাকাব্য। গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতীক হিসাবে সারাবিশ্বে সমাদৃত শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি । সেই জন্যই, বর্তমান সংঘাত পীড়িত বিশ্বে শান্তিপূর্ণভাবে বিবাদ মীমাংসায় শেখ হাসিনাই হবেন তিমির হননের কবি।
|
� পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ � |