টাঙ্গাইল শাড়ি’র স্বত্ব ভারতের, বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থায় অভিযোগ করার দাবি
নতুন সময় প্রতিনিধি
প্রকাশ: Saturday, 3 February, 2024, 11:38 AM সর্বশেষ আপডেট: Sunday, 4 February, 2024, 9:15 AM
বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ির উৎস পশ্চিমবঙ্গের বলে দাবি করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। ইতোমধ্যে দেশটি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়িকে নিবন্ধন করে নিয়েছে।
ভাষার মাসের শুরুর দিনে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে এ বিষয়ে একটি পোস্ট দেয়া হয়। এরপরেই এ নিয়ে অনলাইন ও অফলাইনে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক ও সমালোচনা। দাবি উঠেছে বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থায় এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেন অভিযোগ জানানো হয়।
ভারতীয় ভৌগলিক নির্দেশক রেজিস্ট্রি দফতর বলছে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হ্যান্ডলুম উইভারস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে টাঙ্গাইল শাড়িকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত করা হয়েছে।
ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে দেয়া পোস্টে দাবি করা হয়, টাঙ্গাইলের শাড়ির উৎপত্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পোস্টে আরও বলা হয়েছে, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত, একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রঙ এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত—এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।’
টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস
তবে টাঙ্গাইল শাড়ির রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো একটি কুটির শিল্প। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই শাড়ি বুননের ইতিহাস। তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এর ব্যাপক প্রসার হয়।
বাংলাদেশের অনেক তাঁতি সম্প্রদায় টাঙ্গাইল শাড়ির বুননকর্মে জড়িত। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো তাঁতি সম্প্রদায় হলো টাঙ্গাইলের পাথরাইলের বসাক সম্প্রদায়। বাংলাদেশের আরেক ঐতিহ্যবাহী শিল্প মসলিন। এই মসলিন তাঁতিদের বংশধররাই মূলত টাঙ্গাইলের পুরনো তাঁতি বা কারিগর।
এছাড়া নাম থেকেই স্পষ্ট টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি কোথায়। তবে এ কথা সত্য যে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কিছু তাঁতি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন। তারাই সেখানে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি শুরু করেন। কিন্তু শাড়ির নাম সেই টাঙ্গাইলই রয়ে গেছে। শাড়ির এই ইতিহাস তুলে ধরেছে খোদ ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা।
টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব কতদিন
ভারতীয় নিবন্ধকের তথ্য বলছে, কলকাতা-ভিত্তিক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হ্যান্ডলুম উইভারস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের একটি আবেদনের জবাবে বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি ২০২৪ সালের ২ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান জিওগ্রাফিক ইন্ডিকেশন ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত হয়।
২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর করা ওই আবেদন পরবর্তীতে নিবন্ধিত করে দেয়া হয়। বলা হয়, এই দাবি ৭ সেপ্টেম্বর, ২০৩০ পর্যন্ত বৈধ থাকবে।
এদিকে, বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন কীভাবে টাঙ্গাইল শাড়ি, আনারস, এবং সন্দেশের (দুধ ও চিনি দিয়ে তৈরি এক ধরনের মিষ্টি) জিআই মর্যাদা সুরক্ষিত করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনার জন্য গত ৩০ জানুয়ারি একটি সভা করে।
টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গ দাবি করে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পোস্টে প্রকাশিত স্ট্যাটিক
জেলা প্রশাসক কায়সারুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইলের তিনটি আইকনিক পণ্যের জন্য জিআই মর্যাদার আবেদন করেছি, আশা করি শিগগিরই স্বীকৃতি পাবো।
‘মিথ্যা দাবি’ ঘিরে বিতর্ক
ফেসবুকে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পোস্টের পর ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকেই এর সমালোচনা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে পোস্টটি প্রকাশ করার পর এতে এখন পর্যন্ত চার হাজারের বেশি কমেন্ট পড়েছে। এর প্রায় সবই ভারতীয় দাবির প্রতিবাদ ও সমালোচনা করে।
বেশিরভাগ মন্তব্যে বলা হয়েছে, শাড়টির নাম টাঙ্গাইল। আর সেই টাঙ্গাইলের অবস্থান বাংলাদেশে। এখানেই টাঙ্গাইল শাড়ির জন্মস্থান, পশ্চিমবঙ্গে নয়। এছাড়া আরও অনেকেই এই দাবিকে ‘অদ্ভূত ও হাস্যকর’ বলে অভিহিত করেছেন।
এক পোস্টে বলা হয়েছে, টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য। এটাকে আপনাদের (ভারতের) নিজেদের নামে ব্যাবহার করে অন্যায় করছেন। আশা করি আপনারা এই ভুল সিদ্ধান্ত থেকে অতি শিগগিরই সরে আসবেন।
অপর একজন লিখেছেন, এটা সত্যিই হতাশাজনক যে তারা এমনটা দাবি করছে। তিনি আরও বলেন, ১৯০৬ সালে মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের ল্যাঞ্চাশায়ারের তৈরি কাপড় বর্জন। সেই ডাকে আপামর জনসাধারণের সাড়া দেওয়ায় সেই সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) তাঁত শিল্প প্রসার লাভ করে। তার মানে এই নয় যে, টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের।
তিনি আরও বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাস প্রাচীন। এই তাঁতিরা ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধর। তাদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার ধামরাই ও চৌহাট্টায়। তৎকালীন সময়ে দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘ্রিন্দা এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রণে তাঁতিরা টাঙ্গাইল যান এবং পরবর্তীতে সেখানে বসবাস শুরু করেন। অবিভক্ত ময়মনসিংহের মহকুমা টাঙ্গাইলের নামানুসারে এই শাড়ি টাঙ্গাইল শাড়ি পরিচিতি লাভ করে। টাঙ্গাইল শাড়ি কোনোভাবেই পশ্চিমবঙ্গের নয়।’