ই-পেপার সোমবার ১৪ নভেম্বর ২০২২
সদস্য হোন |  আমাদের জানুন |  পডকাস্ট |  গুগলী |  ডিসকাউন্ট শপ
সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
কবিতা বোঝা ও শেখার বই
নতুন সময় প্রতিবেদক
প্রকাশ: Friday, 2 February, 2024, 11:12 AM

কবিতা বোঝা ও শেখার বই

কবিতা বোঝা ও শেখার বই

‘কবিতার কোনো পাঠশালা নেই, মানবজীবনই কবিতার পাঠশালা। কবিতা লেখা শেখানো যায় না। কিন্তু যা শেখানো যায় না তাকে শিখে নিতে হয়। কবিতা লেখাও শিখে নিতে হয় কবিকে।’


ফ্ল্যাপের এই লেখা পাঠ করে এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে বসে থাকি। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আরও মুগ্ধ হয়ে যাই। প্রিয় প্রিয় এমিলি ডিকিনসনের অমর বাণী লিপিবদ্ধ সেখানে, ‘আমি যদি কোনো বই পড়ি এবং যা আমার সারা শরীরকে এত শীতল করে তোলে যে কোনো আগুনই আমাকে স্পর্শ করতে পারে না আমি জানি সেটাই কবিতা। দৈহিকভাবে যদি আমি অনুভব করি আমার মাথার উপরিভাগ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আমি জানি সেটাই কবিতা।’


কবিতা নানা রকমের হয়। কবিতার সংজ্ঞাও নানা ধরনের আছে। এরিস্টটল থেকে শুরু করে আজ অবধি কত মনীষী কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, তবে তা মীমাংসিত নয়। কবিতা লেখেন অথচ এরিস্টটলের  ‘কাব্যতত্ত্ব’ পড়েননি, নিদেনপক্ষে হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখেননি এমন কবি সম্ভবত বাংলাদেশে নেই। কবিতাবিষয়ক আরও দুটি বহুল পঠিত বই হলো শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’ এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’। বাংলাদেশে কবিতাবিষয়ক বই সৈয়দ শামসুল হকের ‘মার্জিনে মন্তব্য’। তিনি বইটির ‘কবিতার কিমিয়া’ অধ্যায়ে কবিতা সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন।   

আর এবার কবি কামাল চৌধুরী লিখলেন ‘কবিতার অন্বেষণ কবিতার কৌশল।’ যা একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়। কবিতা সম্পর্কে একজন কবির সম্পূর্ণ ধারণা, নিজস্ব চিন্তা, দর্শন থাকলেই কেবল এ ধরনের বই লেখা যায়। বলা যায়, বইটি লেখকের কবিতাবিষয়ক আত্মোপলব্ধি, কারণ প্রত্যেক কবির নিজস্ব কাব্যদর্শন থাকে। বইটি আটটা পর্বে লিখিত। বেশিরভাগ পর্বে আবার একাধিক উপপর্ব আছে।

কবিতার অন্বেষণ : কবিতা ও পদ্য পর্বটি পদ্য ও কবিতা, পদ্যের বৈশিষ্ট্য, ভালো কবিতা বাজে কবিতা সম্বন্ধে।

কবিতা কখন হয়? কবিতা কোথা থেকে আসে? লেখক বলছেন, ‘সময় কবির শ্রেষ্ঠ অনুষঙ্গ, সময় থেকেই কবিকে জীবনাভিজ্ঞতা নিতে হয়।’ কবিতা কীভাবে জ্যান্ত থাকে, এ ব্যাপারে ড্যানিশ দার্শনিক সোরেন কিয়োর্টেগার্ডের মতামত তুলে ধরেছেন। কবিতা এক অন্তহীন যাত্রা কিংবা বলা যায় এক অন্তহীন অন্বেষণ। এই যাত্রা অন্তর্গত, ফল্গুধারার মতো, ক্রমাগত কর্ষণের দ্বারা হৃদয়কে শানিত করে ফসল ফলাতে হয়। তখন মনে হতে পারে water water every where nor any drop to drink এ  প্রসঙ্গে লেখক কেনিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন।

কবিতা ও পদ্যের পার্থক্য না বুঝে কবিতা লেখা কি উচিত? তেমন জানেঅলা গুরু না হলে এই পার্থক্যটা বোঝাও কঠিন। কামাল চৌধুরী এই গুরুর গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করেছেন। ‘কবিতার অন্বেষণ কবিতার কৌশল’ বইটি পড়ে সবিস্তারে বোঝা যাবে কবিতা ও পদ্য কেমন হয়। তিনি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ‘কাজলা দিদি’র উদাহরণ দিয়েছেন, ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই’ এই পঙ্্ক্তি পদ্য হলে ‘মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই’ হলো কবিতা। এমন আরও উদাহরণ, ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি কবিতা ও পদ্যের পার্থক্য বুঝিয়েছেন।

সব ভাষায় ভালো কবিতা বাজে কবিতা আছে। হেরমেন হেস বলেছেন, যা একসময় মনে হয়েছে ভালো কবিতা, সময়ের বিচারে তাই হয়ে গেছে বাজে। জর্জ অরওয়েল দেখিয়েছেন ইংরেজি ভাষায়ও বাজে কবিতা আছে। ছাপাখানা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতা লেখা টেকসই হওয়ার অন্তরায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, একটা লেখা লেখার পরেই প্রকাশ করা যাবে না। কিছুদিন ফেলে রাখতে হবে। এক বছর পরে সেটা আরও উন্নত হয়ে উঠবে।

দ্বিতীয় পর্বের বিষয় কবিতার ভাষা। প্রত্যেক বড় কবির নিজস্ব ভাষা আছে, সেটা মাতৃভাষা নয় কাব্যভাষা। দেশে মমতাজের মতো অসংখ্য কণ্ঠশিল্পী আছে, কিন্তু তাদের গান আমরা শুনি না। আসল থাকতে নকল আমরা শুনব কেন? তাহলে কবির করণীয় কী? হ্যাঁ, কবির করণীয় হলো ভাষার মধ্যে গভীরভাবে অভিনিবেশ-অবগাহন করে নিজস্ব ভাষা তৈরি করা, একেই কাব্যভাষা বলে। আর কাব্যভাষা তৈরি করতে হলে চেনা জগৎকে আলাদা রূপ দিতে হবে; যিনি এটা সর্বাত্মক ভালোভাবে করবেন, তিনি পাঠকের হৃদয়ে তত বেশি জীবন্ত হয়ে থাকবেন।

তৃতীয়, পঞ্চম ও সপ্তম পর্বে কবিতার ছন্দ, অক্ষর বা সিলেবল, মাত্রা, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, সনেট, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, স্বরমাত্রিকা, স্বরবৃত্ত ছন্দ, পয়ার ও মহাপয়ার, মুক্তক বা মুক্তবন্ধ, চিত্রকল্প, উপমা ও রূপক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে।

বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লিখে তাক লাগিয়ে দেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আমেরিকার এক ছন্নছাড়া কবি ১৮৫৫ সালে লিখিত  Leaves of grass  বইতে কবিতার মানচিত্র বদলে দেন। তিনি কবিতার চিরায়ত ছন্দ, বিন্যাস ভেঙে নতুন পথের দিশা দেন। বাংলায় মুক্তক ছন্দের প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে তিনি হুইটম্যানের ফ্রি-ভার্স ও এজরা পাউন্ডের ফ্রি-ভার্সের পার্থক্য বিচার করেননি। এদিকে আবদুল মান্নান সৈয়দ মুক্তছন্দের স্থলে মিশ্রছন্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী। ইউরোপে চিত্রকল্প বা ইমেজিস্ট আন্দোলনের (১৯১২-১৯১৭) প্রবক্তারা ইমেজকে কবিতার প্রাণ হিসেবে দেখতেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা চিত্ররূপময়। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্নার হল সবুজ / চুনি উঠল রাঙা হয়ে।’ এখানে পান্না, চুনি জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে চেতনার রঙ মেশাতেই তা অনির্দিষ্ট ও বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। এমন নানা ধরনের যৌক্তিক ব্যাখ্যায়, তথ্যে বইটা উর্বর।

চতুর্থ পর্বে কবিতার মিল-অন্ত্যমিলের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সাধারণ পাঠক মনে করেন কবিতার মিলই কবিতার ছন্দ, বিশেষ করে অন্ত্যমিল। মিল না থাকলে বলা হয় কবিতায় কোনো ছন্দ নেই। কিন্তু যিনি কবিতা লিখবেন তিনি এমনটি জানলে কবিতার বারোটা বেজে যাবে। জোসেফ ব্রডস্কি বলেছেন, যখন দুটি জিনিস একই শব্দের সৃষ্টি করে কিন্তু তাদের অর্থ বদলে যায় তখনই মিলের সৃষ্টি হয়। মিলের মাধ্যমে কবিতার শব্দ, লাইন, অনুভূতি ইত্যাদির মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। মিল ছন্দ-প্রকরণের অংশ হলেও কবিতার শরীরের অত্যাবশ্যক অঙ্গ নয়।কবিতায় মিল দেওয়া সহজ কাজ নয়। এ জন্য ছন্দ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে কবির কাব্যবোধ ও সক্ষমতায় দৈন্যের প্রকাশ ঘটবে। মিল বোঝার জন্য স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির সম্পর্ক  বোঝাও দরকার। ষষ্ঠ পর্বে পঙ্্ক্তি, পদ, কবিতার পঙ্্ক্তি ভাঙা, কবিতার ফাঁকা জায়গা বা স্পেস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অষ্টম পর্বটি গদ্যছন্দ-গদ্যকবিতা নিয়ে। ক্রিস্তা জারা ছিলেন উধফরংস-এর প্রবক্তা। তিনি প্রথাবিরোধী বা নৈরাশ্যবাদী কবিতার সূত্রপাত ঘটান। পাশ্চাত্যে ওয়াল্ট হুইটম্যান হলেন গদ্যকবিতার জনক। বোদলেয়ার, মালার্মে হয়ে গদ্যকবিতা এক শক্তিশালী উচ্চস্বর ধারণ করে। বাংলায় এ ধারার সূচনা করেন বুদ্ধদেব বসু কর্র্তৃক ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যকবিতা চয়নে। এ প্রসঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, ‘বই খুলে প্রথমে আমরা চমকে গিয়েছিলাম সে আমলে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু গদ্য আছে কাব্যাক্রান্ত। ত্রিশের দশকের কবিরাও ছন্দমুক্তি চেয়েছিলেন, কিন্তু গদ্যকবিতার প্রতি আসক্তিও ছিল না। কবি শামসুর রাহমান বলেছেন, ‘সত্যি বলতে কী, গদ্যছন্দের মুক্তি একজন সমর সেনের জন্য অপেক্ষায় ছিল।’ গদ্যকবিতায় বাক্যের আকার, পঙ্ক্তি বিভাজন, সগতোক্তি কিংবা সংলাপ প্রয়োগ, অন্তর্ঘাতের অভিযোজন এ জন্য কবিকে জানতে হবে ছন্দ, কৌশল। গদ্যকবিতা কেবল গদ্য নয় এটি গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে, নয়তো এ ধরনের কবিতায় উৎকর্ষ ঘটানো সম্ভব নয়। সিকদার আমিনুল হকের ভাষায়, ‘দক্ষতায় শ্রেষ্ঠদের জন্য গদ্যকবিতা।’ এই দক্ষতা বলেন, কৌশল বলেন, শিক্ষা বলেন তার সমাহার ঘটেছে ‘কবিতার অন্বেষণ কবিতার কৌশল’ বইতে।

সমকালীন বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি কামাল চৌধুরীর কবিতার বোধোদয়, কবিতার করণকৌশল, কবিতার দর্শন বুঝতে ‘কবিতার অন্বেষণ কবিতার কৌশল’ বইটি তরুণ কবিদের খুব সহায়তা করবে, এমনকি কথাসাহিত্যিক ও কাব্যরসিক পাঠকদের আরও ভালো করে কবিতা বুঝতে ভূমিকা রাখবে। এ বইটি সম্পদগুণে সৈয়দ হকের ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’-এর সমমর্যাদায় আসীন হবে, এ কথা বেশ জোড়ালভাবে বলা যায়।

পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: নাজমুল হক শ্যামল
দৈনিক নতুন সময়, গ্রীন ট্রেড পয়েন্ট, ৭ বীর উত্তম এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী বা/এ, ঢাকা ১২১২।
ফোন: ৫৮৩১২৮৮৮, ০১৯৯৪ ৬৬৬০৮৯, ইমেইল: info@notunshomoy.com
কপিরাইট © দৈনিক নতুন সময় সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft
DMCA.com Protection Status