সেদিন আরাভ খানের বাসায় যেভাকে খুন হয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা মামুন
নতুন সময় ডেস্ক
|
![]() সেদিন আরাভ খানের বাসায় যেভাকে খুন হয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা মামুন তখন বাসার একটু দূরে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা দেখছিলেন রবিউল ইসলাম, সাম্প্রতিক সময়ে যিনি আরাভ খান নামে পরিচিত। বনানীর ওই বাসা ছিল তাঁরই। যদিও তিনি এটিকে তাঁর অফিস বলে উল্লেখ করেছেন। বাসায় ডেকে আনার পর ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে হাত–পা বেঁধে মামুনকে বেদম মারধর করেন রহমতউল্লাহ, দিদার ও আতিকেরা। ওই রাতেই মামুনের মৃত্যু হয়। পরে রহমত উল্লাহর পরিকল্পনায় বাইরে থেকে দুটি বস্তা ও একটি সাদা কাপড় নিয়ে আসেন রবিউল। সেই বস্তায় ভরে মামুনের লাশ গাড়িতে করে গাজীপুরের একটি জঙ্গলে নিয়ে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মামুন হত্যা মামলার অভিযোগপত্র ও তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তদন্ত সংস্থার সূত্রমতে, মামুন, রহমতউল্লাহ এবং ওই তিন নারী টেলিভিশনে ‘ক্রাইম ফিকশন’ নামে একটি অনুষ্ঠানে অভিনয় করতেন। সেই সুবাদে তাঁদের পরিচয়। এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই মামুনকে ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা করেন রবিউল, রহমতউল্লাহ ও তাঁদের সহযোগীরা। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই বনানীতে খুন হন পুলিশ পরিদর্শক মামুন। ঘটনার তিন দিন পরে তাঁর ভাই বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ এ মামলায় রহমত উল্লাহ, রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সেখানে রবিউল ইসলামকে পলাতক উল্লেখ করা হয়। পরে আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। রবিউল নিজেকে বাঁচাতে চাঁদপুরের আবু ইউসুফ নামের এক যুবককে তাঁর পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করান। বিনিময়ে আবু ইউসুফকে নানা প্রলোভন দেখানো হয়। প্রায় ৯ মাস জেল খেটে সত্য প্রকাশ করেন ইউসুফ। পরে আদালতের নির্দেশে বিষয়টি তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির তদন্তে উঠে আসে, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামি রবিউল নাম দিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ইউসুফ। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, মামুন হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান রবিউল ইসলাম। সেখানে তিনি বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। পাসপোর্টে নাম দেওয়া হয় আরাভ খান। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এখন তিনি দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী। গত বুধবার রাতে দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে আরাভ জুয়েলার্স উদ্বোধন করতে যান বাংলাদেশি ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান, চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাসসহ কয়েকজন তারকা। গোয়েন্দা পুলিশের ভাষ্য, আরাভ খান পুলিশ হত্যা মামলার পলাতক আসামি, এ তথ্য তারকাদের জানানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তাঁরা সেখানে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অভিযোগপত্রে যা আছে পুলিশের অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, বনানীর ২ নম্বর সড়কের ৫ নম্বরের ওই বাসায় নিয়ে আসামি দিদার, স্বপন, রহমত উল্লাহ পুলিশ কর্মকর্তা মামুনের হাত-পা বেঁধে ফেলেন। পরে ওই তিন আসামির সঙ্গে মিজান, আতিক ও ছারোয়ার যুক্ত হয়ে মামুনকে নির্দয়ভাবে মারতে থাকেন। এতে মামুন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। রাত ১০টার দিকে আসামি কেয়া (রবিউলের স্ত্রী), আফরিন ও মীম বাসা থেকে চলে যান। রাতের কোনো একসময় সেখান থেকে চলে যান রবিউলও। গভীর রাতে আসামি আতিক আসামি স্বপনকে ডেকে বলেন, ‘দাদা, দেখেন তো পুলিশ কর্মকর্তার হাত-পা কেমন শক্ত মনে হচ্ছে।’ ভোরবেলায় তাঁরা নিশ্চিত হন যে মামুন মারা গেছেন। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, মামুন মারা যাওয়ার পর রহমত উল্লাহ সবাইকে বলেন, লাশ গুম না করলে তাঁরা সবাই বিপদে পড়ে যাবেন। কারণ, মামুন তাঁর বন্ধু। তিনি মামুনকে ফোন করে ডেকে এনেছেন। রহমত উল্লাহর মুঠোফোনের শেষ কলটিও তাঁর (মামুন)। তখন স্বপন মুঠোফোনে রবিউলকে মামুনের মৃত্যুর বিষয়টি জানান। স্বপন বলেন, ‘এখন আমরা কী করব? আপনি সকালে এখানে আসেন।’ পরে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে দুটি বস্তা ও একটি সাদা কাপড় নিয়ে বাসার নিচে আসেন রবিউল। তাঁর কাছ থেকে বস্তা নিয়ে বাসার ওপরে যান দিদার। এ সময় রহমত উল্লাহ, আতিক ও মিজানকে সঙ্গে নিয়ে বাসার নিচে গিয়ে তাঁর ব্যবহৃত প্রাইভেট কারটি লিফটের দরজার কাছে নিয়ে রাখেন। সকাল সাতটার দিকে স্বপন, দিদার ও আতিক মিলে মামুনের লাশ লিফটে করে নিচে নামান। সবাই মিলে গাড়ির পেছনের অংশে লাশ তোলেন। পরে রহমত উল্লাহ ওই গাড়ি চালিয়ে বনানীর রোডে যান। গাড়িতে ছিলেন দিদার, স্বপন ও আতিক। সেখানে রবিউল, তাঁর স্ত্রী আসামি কেয়া, মেহেরুন্নেছা ও মীমকে সঙ্গে নিয়ে একটি মোটরসাইকেলসহ অপেক্ষায় ছিলেন। পরে সেখান থেকে রবিউলের মোটরসাইকেল অনুসরণ করে রহমত উল্লাহ গাড়ি চালাতে থাকেন। খিলক্ষেতের একটি পাম্পে গিয়ে মোটরসাইকেলে তেল নিয়ে রবিউল ফিরে আসেন। আর গাড়ি নিয়ে রহমতউল্লাহ যান গাজীপুরের দিকে। এ সময় রবিউলের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে কথা বলেন দিদার ও স্বপন। গাজীপুরের শিমুলতলীতে দিদার, স্বপন ও আতিক একটি দোকান থেকে সাত লিটার পেট্রোল কেনেন। রবিউল আসামি স্বপনের মুঠোফোনে টাকা পাঠান। পরে রাত সাড়ে আটটার দিকে উলুখোলা থেকে আবদুল্লাহপুর যাওয়ার পথে একটি বাঁশবাগানে পেট্রোল ঢেলে মামুনের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর গাড়ি নিয়ে সবাই ঢাকায় ফিরে আসেন। পুলিশ কর্মকর্তা খুনের ঘটনা নিয়ে বুধবার আরাভ খান নামে ফেসবুক আইডি থেকে লাইভে এসে রবিউল বলেন, ‘আমি এই খুনের সঙ্গে জড়িত না। আমার অফিসে মার্ডারটা হয়েছিল। কিন্তু আমি ছিলাম না। আমার একটি অপরাধ ছিল, যেখানে খুন হয়েছে, আমি ওই অফিসের মালিক। জন্মদিনের একটি অনুষ্ঠানে কথা–কাটাকাটি নিয়ে ঘটনাটি ঘটে।’ রবিউল ওরফে আরাভ খান বলেন, ‘আমার অফিসে খুন হয়েছে। এর জন্য আদালত আমার বিচার করবে। আমি মাথা পেতে নেব। যতটুকু অপরাধ আমি করেছি, ততটুকু সাজা আমার হোক, সেটা চাই।’ ডিবি সূত্র জানায়, এ মামলায় দুটি অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। আসামিদের মধ্যে দুজন কিশোরী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কিশোর আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাকি আটজনের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। শিগগিরই সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে। গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে রহমত উল্লাহ, স্বপন, মিজান, আতিক ও ছারোয়ার জামিনে মুক্ত আছেন। দিদার কারাগারে রয়েছেন। আর রবিউল ইসলামসহ দুজন পলাতক। ফেব্রুয়ারিতে দেশে আসেন রবিউল রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে আসেন। তখন পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। ৮ ফেব্রুয়ারি আরাভ খান নামের ফেসবুক আইডি থেকে লাইভে এসে রবিউল গোপালগঞ্জ শহরের একটি তিনতলা বাড়ি দেখিয়ে বলেন, এটা তাঁর গোপালগঞ্জের গ্রামের বাড়ি নয়। এটা তাঁর ব্যক্তিগত বাড়ি। এখানে তিনি থাকেন। পরে বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের একটি মোটরসাইকেল নিয়ে স্থানীয় বাজারে গিয়ে মাছ কেনেন তিনি। ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশে এসে তিনি (আরাভ) যে ফেসবুক লাইভ করেছিলেন, সেটি আমরা দেখেছি। তিনি কোন পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশে আসতেন, সেই তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।’
|
পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ |